তাবলীগ নিয়ে কিছু লিখব কখনো ভাবিনি। তাবলীগ আশে পাশের জীবনকে বদলে দিচ্ছে দেখে লিখতে মন চাইল। পরিসর বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বেশি জনের জীবন-কথা এখানে গাঁথা যায়নি। আমার পড়শী আবুল হাশেম। পেশায় কামলা। মসজিদে নামায শেষে একদিন তাবলীগের বয়ান শুনে। বয়ান উপস্থাপন করেন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরের পরিচালক। ঘরে এসে হাশেম বউকে বলেÑ তিন দিনের জন্য দ্বীনের দাওয়াত-কাজে বের হব। মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েছি। বয়ান শুনে বুঝলাম মুসলমান যাকে বলে তা হয়নি। ডাক্তারের ঘরে জন্ম নিয়ে ডাক্তারী বিদ্যা না শিখে যেমন ডাক্তার হতে পারে না, আমরাও কেবল জন্ম পরিচয়ে মুসলমান দাবী করলে কতটা সঠিক হয়? তাই মুসলমানী শিক্ষা লাগবে। কিছু শিখে আসি। বউ কথাগুলো শোনে আর ভাবেÑ মানুষটা শেখার সুযোগ পায় নাই। প্রতিদিন অন্যের কাজ করে রোজগার করে। সন্ধ্যায় ফিরে ভাল ব্যবহার খুব কমই করে। কিছু জেনে শুনে আসলে কেমন হয় দেখি। কাপড়-চোপড় একটি থলেতে গুছিয়ে দিয়ে স্বামীকে আগায়ে দিল। হাশেমের হাতে শ-তিনেক টাকা ছিল। দুশ’ টাকা নিজের কাছে রাখলো, বউকে ১শ’ টাকা দিয়ে বিদায় নিল। এদিকে ঘরে রোজগার বন্ধ। ১শ’ টাকার চাল-ডাল কিনে তিন ছেলেমেয়ের সংসারটি প্রথম দিন চলল। পরদিন জমানো মুঠি চালগুলো বের করলো। মাটির ব্যাঙ্কে রাখা মুদ্রাগুলো নিল। দিন এভাবে চলতে লাগল। চার দিনের মাথায় স্বামী ফিরল। তখন দুপুর বেলা। বউ শরবত দিল। আগে কী রকম ছিল আর এখন কী রকম হলো তা পরখ করে দেখতে চাইল। কেমন মুসলমান হলো তাও বুঝতে হবে। ফন্দি করে শরবতে চিনি না দিয়ে লবণ গুলিয়ে দিল। স্বামী শরবত খেয়ে বলে উঠলো, “আলহামদুলিল্লাহ।” বউ অবাক। তরকারিতে লবণ একটু বেশি হলে যে মানুষ পেয়ালা ছুঁড়ে মারতো, সে মানুষ মোটেই রাগ দেখালো না। বরং শোকর করলো। মানুষটারে হুজুরেরা তাবিজ-টাবিজ ছোঁয়ালো বুঝি! তা হলেও দোষ নাই। ফলতো ভালই হয়েছে। এখন হাসিমুখে কথা বলে। আমার কাজে-কর্মে সাহায্য করে। আমার কোন রকম কষ্ট হয় কিনা খেয়াল রাখে। মেয়ে মানুষ বলে আমাকে তেমন দাম দিত না। এখন আমাকে দাম আর মান দু’টিই দেয়। বাঁশের বেড়ার টিনের চালার ছোট দুই কক্ষের ভাড়া ঘরে তাদের সংসার। অদূরে জহির মিয়ার ঘর। তার বউকে সবাই রিপার মা বলে ডাকে। রিপার মা এতোদিন হাশেমের ঘর থেকে ঝগড়া-ঝাটির আওয়াজ শুনে আসছে। এখন তা আর নাই। হাশেম বউকে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকে, সালাম দিয়ে বের হয়। অভাব-অনটনের মধ্যেও হাসি-খুশির কী সুন্দর সংসার। এমনটা আমাদেরও চাই। হাশেম ভাল মানুষ কী করে হলো সে কিস্সা আগে শুনে নিল। শুনে আর দেরি নেই, রিপার বাবাকে সে পূণ্য কর্ম-সাধনায় পাঠিয়ে দিল। রিপার বাবা সহজে যাবার নয়। অসুখের দোহাই দিল। তার দোকান কেমনে চলবে সে কথাও তুলল। তাবলীগ-মিশনে গেলে ঘরবাড়ির কী হবে তা নিয়েও অনুযোগ। রিপার মা নাছোড় বান্দা। স্বামীকে ঘরের দুয়ার পর্যন্ত আগায়ে দিয়ে স্বপ্নের শ্বাস নিল। জহির আহমদ জেলা তাবলীগের কেন্দ্রীয় মসজিদে নাম লেখাল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ মসজিদ থেকে সে মসজিদে ৪০ দিন কাটায়ে ফিরে আসল। মুখে হাসি।
বউকে সালাম দিল। বউ সম্মানিত হল। বউয়ের স্বগোক্তি-কোন কিছু করতে আমার স্বামী এখন আমার পরামর্শ নেয়। কিছুতে মনে কষ্ট পেলে সবর করে। বিজ্ঞ জনদের অভিমত-নারীর প্রতি পুরুষের এরূপ সম্মান-মর্যাদা পরিবারে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করে। পারিবারিক ক্ষমতায়ন নারীর সামাজিক ক্ষমতায়নের ভীত রচনা করে। জহির ছেলেকে দোকানে রেখে আল্লাহ্র রাস্তায় বের হয়েছিল। অসুখের বিষয়ে বলল, দিন ভাল-ই গেছে। ছেলে বাবাকে জানাল, দোকানে বেচা-বিক্রিও বেশ ভালো হয়েছে। রিপার মা খুশিতে নিজেকে নিজে বলে- তাবলীগে পাঠিয়ে ভালই করলাম। তাবলীগের ফায়দার কথা হাশেমর বউ থেকে রিপার মায়ের কানে, রিপার মায়ের মুখ থেকে খোকনের বউয়ের কানে গেল। খোকনের বউয়ের দেরী আর সয় না। ঘরে টাকা যা আছে তা দিয়ে স্বামীকে তৈরী করে দিল। খোকন ফার্নিচারের দোকানী। একদিকে বউয়ের চাপাচাপি অন্যদিকে দোকানের বিকিকিনি। একদিকে শয়তানের টান, অন্যদিকে ফেরেশতাদের হাতছানি। শয়তানের পরাজয় হলো। খোকন দোকান বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল। যুবক মানুষ। একেবারে ৪০ দিন দ্বীনের ব্যবহারিক শিক্ষা শেষ করে ফিরে আসে। আগে মুখে দাঁড়ি ছিল না। ফিরল মুখে দাঁড়ি নিয়ে। সুন্নতের স্বর্ণমুখটি হলো সবাইকে কাছে টানার মতো। দোকান আবার চালু করল। আল্লাহ পাকের কী শান ফার্ণিচারের জন্য অর্ডারের ওপর অর্ডার। আগে দু’জন কর্মচারী কাজ করতো, এখন ৪ জন কর্মচারী দিয়ে ওভারটাইমে কাজ করেও কাজ শেষ করতে পারছে না। দোকান বন্ধ থাকায় ব্যবসা যেটুকু পিছিয়ে গিয়েছিল, এখন তা বহুগুণে বেড়েছে। তার কথায়Ñ দ্বীনের প্রশিক্ষণ স্কুলের আমলে ব্যবসায় কম মুনাফা করে বরকতি সুবিধা বাড়িয়েছে। কর্জ্জ যা ছিল, শোধ করতে পেরেছে। আগে জুমার আজানের পরও কর্মচারীরা দোকানে কাজ করতো, এখন জুমার দিনে দোকান বন্ধ রেখে কর্মচারিদের মসজিদে পাঠায়। হাশেমের ঘরে সুখ আসলো। জহিরের ঘরে শান্তি। খোকনের ব্যবসায় সাফল্য। দিন তাদের বদলে গেল সুখ-শান্তি ও সাফল্যের অভিমুখে। দ্বীন-ই পারলো তাদের দিন বদলে দিতে। কুদ্দুছ বৈয়াতীর মুখে দিন বদলের গান কে না শুনেছে? অত্র নিবন্ধকার নিজেও সংবাদপত্রে ‘বদলে যাই, বদলে দিই’, শিরোনামে লিখেছে। দৈনিক প্রথম আলো জীবন আঁধারে নন-স্টপ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। আঁধার এতটা জমাট যা ভেদ করে আলো অনুপ্রবেশের সুড়ঙ্গ তৈরি করা যায়নি। আঁধারের আড়ালে পড়ে জীবন জন্ডিসের চেহারা নিয়েছে। যে মহৌষধে জীবন ব্যাধিগুলোর নিরাময় হবে তার সেবনে আমরা তৈরি আছি ক’জন !
লেখক: সাবেক পি.টি.আই সুপার, কনসালট্যান্ট ও কলামিস্ট