বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে সব দলের ঐকমত্যে একটি ফর্মুলা চান ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা। যাতে পরবর্তী নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়। এজন্য নির্বাচনের আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ জরুরি বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। এ ব্যাপারে সংলাপের তাগিদ দিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তারা আগের অবস্থানেই রয়েছেন বলে কূটনীতিকরা জানিয়েছেন।
পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশের এক কূটনীতিক গতকাল মানবকণ্ঠকে জানান, সম্প্রতি কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও এ নিয়ে কূটনৈতিক মহলে উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগাম নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের মধ্যে জোর তৎপরতা না থাকলেও আমরা চাই বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া দরকার। কবে নির্বাচন হবে সেটা এদেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো নির্ধারণ করবেন। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে একটি ঐকমত্য হওয়া দরকার। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এ ব্যাপারে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা বের করা জরুরি। কারণ, নির্বাচনের আগে বার বার প্রক্রিয়া নিয়ে হরতাল, অবরোধ ও প্রাণহানির ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতেই দীর্ঘমেয়াদি একটি ফর্মুলা দরকার। আমাদের বিশ্বাস রাজনৈতিক দলগুলো একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা বের করতে পারবেন। কী ধরনের ফর্মুলা হবে তা রাজনৈতিক দলগুলোকেই ঠিক করতে হবে। তবে কূটনীতিকদের সহযোগিতা চাইলে তা দিতে আমরা প্রস্তুত।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাটও বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ওপর জোর দেন। এজন্য চাইলে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতেও যুক্তরাষ্ট্র রাজি আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানান তিনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একই ধরনের কথা বলা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা মানবকণ্ঠকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু এখন এ নিয়ে আর কথা বলেন না তারা। এর ধারাবাহিকতায় বিদেশি কূটনীতিকদের আর সোচ্চার হতে দেখা যায় না বা খুব বেশি কথাও বলেন না। এমনকি বাংলাদেশে এখন মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়েও তাদের কোনো কথা বলতে দেখি না। তবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ আছে। দেশে যখন রাজনৈতিক সংঘাত বেড়ে যায়, তখনই কেবল বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা দেখা যায়। জাতিসংঘ থেকেও সংঘাতকালীন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। কিন্তু দেশের বর্তমান শান্তিপূর্ণ অবস্থায় তাদের তেমন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। নিজ নিজ দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া রাজনৈতিক বিষয়ে তেমন মন্তব্য করতে চান না বিদেশি কূটনীতিকরা।
এদিকে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এখনো একে অপরের প্রতি কূটনীতিকদের কাছে নালিশ জানাতে তৎপর রয়েছে। এজন্য ইফতার পার্টির রজানীতিও করেছে দলগুলো। ঈদের আমন্ত্রণ জানিয়েও পরস্পর অভিযোগ করা হয়েছে কূটনীতিকদের কাছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের কাছে নালিশ জানানোর এই সংস্কৃতি দেশের জন্য অসম্মানজনক ও অবাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবীর মানবকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে নিজেরা সমঝোতায় আসতে কেন ব্যর্থ হন সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট মেটাতে যখন রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হন এবং সেখানে বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে এনে দূতিয়ালীর দায়িত্ব দেয়া হয় সেটি দেশের জন্য অসম্মানজনক ও অবাঞ্ছনীয়। অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে রাজনীতিকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে পারেন। কিন্তু নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে তৃতীয় পক্ষকে সেই সুযোগ করে দেয়া হয়। আর এই সুযোগটি নিতে তৃতীয় পক্ষের সব সময়ই একটি বিশেষ আগ্রহ থাকে। যেটা আমরাই তাদের করে দিই।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, দেশের প্রাকৃতিক ও জাতীয় দুর্যোগের সময় বিদেশি সাহায্য চেয়ে কূটনীতিকদের ব্রিফ করার প্রচলন ছিল বরাবরই। এর আগেও ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে অবহিত করা হতো। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিক সংকট নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে নালিশ জানানোর ঘটনা গত কয়েকটি সরকারের সময় থেকে শুরু হয়েছে।
বিদেশি কূটনীতিকদের নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এ ধরনের প্রতিযোগিতা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মানবকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতময় পরিস্থিতি আমাদের রাজনীতিবিদরাই সৃষ্টি করেন। এই সংকট নিরসনে তারা নিজেরা ব্যর্থ হন। তখন এই সংকট সমাধানে বিদেশিদের অন্তর্ভুক্ত করেন। কারণ, বিদেশিদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর মতো পরিস্থিতি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তৈরি করে দেন। আর কূটনীতিকদের এই সুযোগ করে দিলে তারাও লুফে নেন। তিনি বলেন, এসব সমাধান কূটনীতিকরা কখনই দিতে পারেননি। পারস্পরিক অবিশ্বাস ছেড়ে সংলাপের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরকেই সমাধান করতে হবে। কূটনীতিকরাও এ কথাই রাজনীতিবিদদের বলে যাচ্ছেন।