এম.এ আজিজ রাসেল :
শহরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে রাখাইন মাদক ব্যবসায়ীরা। কোন ভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাদের। সিন্ডিকেট করে প্রকাশ্যে মাদকের ব্যবসা করে যাচ্ছে তারা। মিয়ানমারসহ দেশের আনাচে-কানাচে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে তাদের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় কর্তাদের মাসিক টাকা দিয়ে দাপটের সাথে মাদকের বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বত্র। এতে অল্প দিনেই শূণ্য থেকে এসব মাদক ব্যবসায়ী আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনেছে। করেছে অট্টালিকা বাড়ি। শহরে রয়েছে আরো একাধিক জমি। চলাফেরায় ব্যবহার করছে আলিশান অবৈধ মোটর সাইকেল, কারসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গাড়ি। যেন মাদক পল্লীর স্ব-ঘোষিত রাজ পরিবার। এদের মধ্যে অনেকেই কৌশলে মাদক পাচার করে আসছে। স্বর্ণের দোকান, চুল, বার্মিজ দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে গড়েছে মাদকের কালো স্বর্গ। বড়বাজার রাখাইন পাড়ার ঊষা রাখাইন আইনের আওতায় এলেও শহরে আরো অর্ধশতক মাদক ব্যবসায়ী অধরা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাউল বাজার এলাকার শচীন রাখাইন, তার প্রধান পার্টনার আবুশে, একই এলাকার মংশেফ্রু আন্তঃজেলায় শক্তিশালী ইয়াবা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। চুল ও স্বর্ণের দোকানের আড়ালে তারা এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে রয়েছে টেকপাড়ার ছৈয়দের পুত্র বাপ্পী। সে দীর্ঘদিন ধরে চোলাই মদ ব্যবসা করার পর ইয়াবা পাচারের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। কয়েকদিন আগে র্যাব-৭ তার টেকপাড়া মসজিদ রোডে তার বাড়িতে অভিযান চালায়। এসময় বাপ্পী কৌশলে সটকে পড়ে। অপরদিকে মংশেফ্রু কোন চাকরি বা ব্যবসা করে না। কিন্তু থাকে নামি ফ্ল্যাটে। বাড়িতে রয়েছে দামি আসবাবপত্র। চলাফেরায় রাজার হাল। চাউল বাজার রোড সংলগ্ন তার বাড়িতে অভিযান চালালে খুলবে উম্মোচিত হবে রহস্যের জট। তাদের মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে সোনাইছড়ি, টেকনাফ, হ্নীলা ও চৌফল দন্ডীর কিউবা রাখাইন, তার ভাই আন্তর্জাতিক মাদক পাচার দলের তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী চবা রাখাইন। আরেক প্রভাবশালী মিয়ানমারের নাগরিক মাছ বাজার এলাকার লাচিং প্রু ওরফে চশমানি দীর্ঘদিন থেকে ইয়াবা, হিরোইন, ফেন্সিডিলের ব্যবসা করে কালো টাকার পাহাড় গড়েছে। তার বড় ছেলে উক্যা মং মিয়ানমারের আকিয়ার জেলা সদরে সস্ত্রীক বসবাস করে। সে তার লোকদের মাধ্যমে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা বড়িসহ বিভিন্ন বিদেশি মাদক কক্সবাজারে পাঠায়। সে ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী গোপনে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করে থাকে। আর এখানে বসে লাচিংপ্রু রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে । এ মাদক স¤্রাজ্ঞীকে সহযোগিতায় রয়েছে তার তিন কন্যা আম্মা, লালা ও ছেও রাখাইন। সে তিন বার হাজত কেটেছে। তার বড় মেয়ে সাথে আম্মা রাখাইনও। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজার জেলাজজ আদালতে এ সংক্রান্ত প্রায় ৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যার নং ২৯৫/২০০৯, ৩৬/ ২০১২ ও ৪২ /২০১৪। এসব অভিযানে অভিযানকারী দল বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, হিরোইন, উদ্ধার করে এ মাদক স¤্রাজ্ঞীর দখল থেকে। পশ্চিম রাখাইন পাড়ায় মিনু রাখাইন, ছেনুর মা (যিনি তিনবার হাজত খেটেছেন) লাকী রাখাইন, তার স্বামী নিরঞ্জণ, বোন থোই থোই, ওসামে রাখাইন ও মারী রাখাইন ফেন্সিডিল, ইয়াবা ও হিরোইনের রাজত্ব বিস্তার করেছে। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা রয়েছে। তাছাড়াও বহাল তবিয়তে মাদকের হাট চালাচ্ছে মংবা চিং, অংমং রাখাইন, মিনু মার্মা, শ্যামা রাখাইন, বিমা রাখাইন, শিশা রাখাইন, নিমা রাখাইন, উধু রাখাইন প্রকাশ মালা রাখাইন, মাকিশা রাখাইন, পেন ইয়াবা, আবুতুনি রাখাইন, নুনু রাখাইন, লাকি রাখাইন, পিংকি রাখাইন, মিশা রাখাইন, আম্মুনি রাখাইন, সুটেং রাখাইন, মংছুয়া রাখাইন, লামচিং স্ত্রী মাওছিন রাখাইন, হুলাশে রাখাইন, সাই চিং, ওরা রাখাইন, মাহ্নমউ রাখাইন, সেওন অং এর মেয়ে মানু, দানুর স্ত্রী মিমি চে, জুচু , উছেছেন রাখাইন ও ইকবাল প্রকাশ পানের দোকান ইকবাল। এ ইকবাল ২০০৯ সালের ৫ জুন মিনু রাখাইনসহ ৯০ গ্রাম হিরোইনসহ গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ দিন জেলখাটে। এ মামলাটি জেলার অতিরিক্ত জজ আদালতে বিচারাধীন। যার মামলা নং এসটি ৩৮৮। এছাড়া জাকেরুল ইসলাম প্রকাশ ছোট বাবু, মিন্টু, আবুল কালাম প্রকাশ আবু, জাফর, কালু, মিনু, বাপ্পী, পাভেল ও চেলেইংগা রাখাইনের পুত্র আবুইয়্যা রাখাইনসহ তার দু‘পুত্র জয়-বিজয় মাদক ব্যবসায় সক্রিয় রয়েছে।
সুত্র জানায়, পুলিশ ডিবি ও মাদকদপ্তের কতিপয় কর্মকর্তা ও সদস্যরা প্রতি মাসে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অংকের বখরা নিয়ে আসে। তাদের বিরুদ্ধে ম্যজিস্ট্রেট ও জজ আদালতে বিচারাধীন মামলার দিনে মোটা অংক টাকার লেনদেন হয়। অনেক সময় তারা আদালতে অনুপস্থিত থাকেন। এ সুযোগে মাদক চক্র আদালতের কতিপয় সহকারীদের মোটা অংকের উৎকোচ দিয়ে পরের হাজিরার দীর্ঘ সময় নিয়ে নেয়। শুধু তাই নয়, মাদক চক্রের মামলা পরিচালক কতিপয় আইনজীবি সহকারীদের কয়েকজনও মাদক ব্যবসায় লিপ্ত রয়েছে। এরা আদালত এলাকায় মাদক বিক্রি করে এবং চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের মাদকের চালান বহনে সহযোগিতা করে। একদিকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অবহেলা ও অন্যদিকে আদালতের দীর্ঘ সময় পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে মাদক ব্যবসার দ্বীগুণ বিস্তিতির সুযোগ লুফে নিচ্ছেন। শহরের মাছ বাজার, চাউল বাজার, বার্মিজ স্কুল রোড, ক্যাং পাড়া, টেকপাড়া, বইল্ল্যা পাড়ায় রহস্যজনকভাবে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের কোন তৎপরতা নেই বললেই চলে। অথচ পুলিশসহ সর্বত্র প্রশাসনের নাকের ডগায় এ ব্যবসায়ীদের অবস্থান। র্যাব এর পাশাপাশি, পুলিশ, ডিবি পুলিশ নিয়মিত তৎপর থাকলে ওইসব চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে অভিমত সচেতন মহলের।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অদিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সুবোধ কুমার বিশ্বাসব বলেন, আমি নতুন এসেছি। তবে কক্সবাজার শহরে চাউল বাজার ও রাখাইনপাড়ায় সবচেয়ে বেশি মাদকের বিকিকিনি হয় তা জেনেছি। ওই এলাকার চিহ্নিত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। তাদের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে প্রতিমাসে অনৈতিক সুবিধা আদায় করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেউ যদি জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফেরদৌস আলী চৌধুরী জানান, মাদক ব্যবাসায়িদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যারা অধরা রয়েছে তালিকা করে শীঘ্রই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। র্যাব-৭ এর কোম্পানী কমান্ডার লেফটেন্যান্ট এস.এম সাউদ হোসেন জানান, বিগত সময় থেকে এ পর্যন্ত চিহ্নিত মাদক স¤্রাজ্ঞীকে মাদক ও অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মাদক ব্যবসয়ীদের আইনের আওতায় আনার জন্য তিনি সাংবাদিকসহ সচতন মহলের সহযোগিতা কামনা করেন।