একের পর এক ঘটে চলেছে পৈশাচিক ঘটনা। উন্মোচিত হচ্ছে সমাজের বিকৃত চেহারা। বেরিয়ে পড়ছে মানবিকতার অধপতন এবং পচনের ভয়াবহ চিত্র। স্তম্ভিত মানুষের বিবেক। ক্রমাগতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা এবং আস্থাহীনতা। মানবতার অধপতন এবং উন্মত্ত পাষবিকতার চিত্র দেখে অনেকে ভুগছেন দগ্ধ যন্ত্রণায় । অনেকে করে উঠছেন আর্তচিৎকার; এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা?
সিলেটে দল বেঁধে উৎসব করে পিটিয়ে শিশু হত্যার পর এবার খুলনায় এক মোটর গ্যারেজ শ্রমিককে মলদ্বারে পাইপ দিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে গত সোমবার রাতে। একই দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালের সামনে থেকে স্যুটকেসভর্তি একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশটি আট থেকে নয় বছরের এক শিশুর। লাশের শরীরে রয়েছে পোড়া দাগসহ নির্যাতনের অসংখ্য চিহ্ন। সিলেটে রাজন হত্যা এবং খুলনায় সর্বশেষ শিশু হত্যার মাঝে সাভার, চট্টগ্রাম এবং নওগাঁয় পিটিয়ে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২৫ দিন বয়সী শিশুকে হাসপাতালের ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যার মাধ্যমে নিষ্ঠুরতার নতুন নজির স্থাপন করল পাষণ্ড এক পিতা। গত ২৭ জুলাই সাভারে ঘটে এ ঘটনা।
0সিলেটে রাজন হত্যার ঘটনা প্রকাশের পর এজাতীয় অনেক নির্মম ঘটনা ফাঁস হতে থাকে ফেসবুক, ইউটিউিবসহ বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে। ঢাকার খিলক্ষেতে কবুতর চুরির অপরাধে একটি শিশুকে নির্মম নির্যাতন করে হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে হত্যার ঘটনা ১৩ জুলাই আপলোড করা হয় ফেসবুকে।
কখনো চোর, কখনো ডাকাত সন্দেহে দল বেঁধে উৎসব করে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে নির্দোষ এবং সমাজের অসহায় বঞ্চিত শিশু, কিশোর এবং যুবকদের। কখনো বা গণধর্ষণ শেষে পৈশাচিক উপায়ে হত্যার ঘটনা থমকে দিচ্ছে সমাজকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমরা একটি অস্বাভাবিক সমাজে বাস করছি। মায়ের গর্ভেও এখন নিরাপদ নয় শিশু। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই যে প্রতিহিংসা এবং নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা চলছে তারই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ আমরা বিভিন্নরূপে দেখতে পাচ্ছি এখন। জোর যার মুল্লুক তার তন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং এর পাশাপাশি বস্তুগত উন্নতির সাথে সাথে নৈতিক মানবিকতার বিকাশের ঘাটতি এবং আদর্শবাদের পতনের ফলে একের পর এক এজাতীয় ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন সমাজ বিশ্লেষেকরা।
শিকার অসহায় আর দরিদ্ররা : সিলেটে পিটিয়ে হত্যার শিকার ১৩ বছরের কিশোর সামিউল আলম রাজন সবজি বিক্রি করত। তার বাবা একজন গাড়িচালক। খুলনায় গত সোমবার গাড়ির চাকায় হাওয়া দেয়ার পাইপ মলদ্বারে ঢুকিয়ে পেটে হাওয়া দিয়ে হত্যা করা হয় ১২ বছরের শিশু রাকিবকে। সে একটি মোটর গ্যারেজে কাজ করত। তার বাবা একজন হতদরিদ্র দিনমজুর। ২০ জুলাই সাভারে সাগর হোসেন নামে ১০ বছরের এক শিশুকে তুচ্ছ অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করে চার-পাঁচজন মাদকাসক্ত যুবক। নিহত সাগর হোসেন দিনমজুরের ছেলে। ১৪ এপ্রিল খিলক্ষেতে কয়েকজন যুবক নাজিম উদ্দিন নামে ১৩-১৪ বছরের এক কিশোরকে কবুতর চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করে। সেও দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ১২ জুলাই চট্টগ্রামে পিকন নামে আট বছরের এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত শিশু পিকনের মা একজন গার্মেন্টশ্রমিক।
পৈশাচিক উপায়ে পিটিয়ে শিশুদের হত্যা, গণধর্ষণ শেষে হত্যাসহ নির্মম নিষ্ঠুর যেসব ঘটনা সম্প্রতি ঘটছে তার প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এর শিকার যারা হচ্ছে তারা সমাজের অসহায় দরিদ্র বঞ্চিত আর শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ। বিশেষজ্ঞরা একে দেখছেন দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার হিসেবে।
কাঁদছে বিবেক
মানবতার অধপতন, উন্মত্ত পাষবিকতা আর পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় কেঁদে উঠছে সব বিবেকবান মানুষের মন। কিন্তু তারা অসহায়। কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ত কুরে কুরে খাচ্ছে অনেককে। অনেকে মুষড়ে পড়ছেন নিদারুণ বেদনায় এমন সমাজ আর দেশ কোনো দিন দেখতে চাননি বলে। পত্রিকার পাতায় খবর পড়ে আর সামাজিক গণমাধ্যমে এসব নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সহ্য করতে পারছেন না অনেকে। নীরবে চোখের পানি ফেলছেন অনেক মা। নিজেকে নিহত শিশুর মায়ের স্থানে কল্পনা করে বুক ভাসাচ্ছেন অনেকে। আবার বিপরীত দিকে পত্রিকা পাঠক একজন মা বলে উঠলেন এসব খবর পড়ে আমার কেন কান্না আসছে না। আমরাও কি তবে এসব দেখতে দেখতে পাষান হয়ে যাচ্ছি? অনেকে তাদের সন্তানদের এসব নিষ্ঠুর খবর পড়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছেন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব নিষ্ঠুর নির্মমতার প্রতিবাদের পাশাপাশি অসংখ্য মানুষ প্রকাশ করে চলেছেন তাদের আর্তি এবং বেদনার কথা। অনেকে খোঁজার চেষ্টা করছেন কবে কিভাবে এ সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর মধ্যে এভাবে পাষবিকতা দানা বাঁধল। কেমন করে মনুষ্যত্ব হারিয়ে এ মানুষগুলো এমন পশুর স্তরে নেমে গেল। মানুষ কেমন করে এমন পৈশাচিক কাজ করতে পারে? প্রতিটি নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনার প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠছে সমাজের অসহায় মানুষের হৃদয়ক্ষরণের চিত্র।
রাজন হত্যার পর ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘রাজন, যে মাটিতে তুমি শুয়ে আছো এ তোমার দেশ ছিল। এখানেই তুমি ভূমিষ্ঠ হয়েছ; হামাগুড়ি দিতে দিতে একদিন দাঁড়িয়ে এই দেশকেই তুমি দেখেছ। আজ মাতৃভূমি তোমাকে যে দাম দিলোÑ এ আমার জাতির লজ্জা। তোমার জীবনের শেষ আর্তিগুলো ফ্রেম-বন্দীÑ কিন্তু আমি ভয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছি।’
আরেকজন অসহায় মানুষ ফেসবুকে লিখেছেন, আমরাও ছোটবেলায় চুরি করে অনেকের গাছের ফল খেয়েছি। আমাকেও রাজনের মতো মেরে ফেল।
শিশুর লাশ নয় বস্তাবন্দী মানবতা
২৬ মে রাজধানীর কদমতলী এলাকার একটি ডোবা থেকে বস্তাবন্দী অবস্থায় হাত-পা বাঁধা এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, লাশটি আনুমানিক ১০ বছর বয়সী এক শিশুর।
এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা থেকে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। আর গত সোমবার গভীর রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে স্যুটকেসভর্তি শিশুর লাশ। শরীরে তার পোড়া দাগের ক্ষত। ১৪ এপ্রিল রাজধানীর পল্লবীতে রিজার্ভ ট্যাংকের ভেতরে মিলল চার বছর বয়সী রবিউল ইসলাম নামে এক শিশুর লাশ।
২৬ মে নোয়াখালীতে এক শিশু শিক্ষার্থীকে গলা টিপে ও মুখে বালু গুঁজে খুন করা হয়েছে। ১৬ মে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় তিন শিশুকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।
গত এপ্রিল মাসে চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের দোভাগী এলাকার একটি ভুট্টাক্ষেত থেকে ডাক্তারপাড়া গ্রামের আশরাফুল আলমের মেয়ে আঁখি (৮) ও একই এলাকার আব্দুল লতিফের মেয়ে লতিফা (৮) মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিখোঁজের চার দিন পর তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়।
১৩ মে পাবনার চাটমোহরে আয়শা হুমায়রা জিম নামের দুই বছরের এক শিশুকন্যাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে।
১৩ এপ্রিল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নে বাবা মশিউর রহমান রিপন (৩৮) শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন এক মাস বয়সী শিশুপুত্র লুৎফর রহমান রিয়াদকে। ৯ মে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় শারমিন আক্তার (৩০) নামে এক মা তার যমজ দুই শিশুকে হত্যা করেছেন। নিহত যমজ দুই শিশু হলোÑ আয়েশা আক্তার (৩) ও মরিয়ম আক্তার।
এভাবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন নগর-বন্দর এবং শহর ও শহরের আনাচে-কানাচে মিলছে অসহায় শিশুর লাশের সন্ধান। কখনো পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে মা-বাবার হাতেও নির্মমভাবে প্রাণ হারাচ্ছে অবুঝ শিশুরা। আবার কখনো বা সমাজের মানুষ নামক কিছু পশুর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে সরলপ্রাণ শিশুরা।
নিষ্ঠুরতার নতুন নজির : সাভারে ফজলুল হক নামে এক ট্রাকচালক তার ২৫ দিন বয়সী সন্তানকে হাসপাতালের ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে নিষ্ঠুরতার নতুন নজির স্থাপন করেছেন। জন্মের পরপরই ফজলুর শিশুটি রক্তে জীবাণুর সংক্রমণ ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। গত ৬ জুলাই চিকিৎসার জন্য এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর একপর্যায়ে সেরেও ওঠে শিশুটি। তবে শেষ পর্যন্ত বাবার নিষ্ঠুরতার কারণে বাঁচতে পারল না অবুঝ শিশুটি। শিশুটির মা বাকপ্রতিবন্ধী। ২৬ জুলাই রোববার তাদেরকে হাসপাতালের বিল এবং রিলিজপত্র দেয়া হয়। বেশ কয়েক দিন হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়ার সময় বিপুল বিল দেখে ভয় পান শিশুর বাবা ফজলুল হক। তার আরো আশঙ্কা হয় নবজাতকটি মায়ের মতো প্রতিবন্ধী হতে পারে। তাই বন্ধুদের কুপরামর্শে হাসপাতাল ত্যাগের আগে গত ২৭ জুলাই ভোরে মায়ের কোল থেকে শিশুটিকে চুরি করে বাবা ফজলুল হক সাততলায় নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেন। চারতলার কার্নিশে আটকে যায় শিশুটি এবং সেখান থেকেই তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
শরীরে হাওয়া ঢুকিয়ে শিশু হত্যা : খুলনায় একটি মোটর গ্যারেজে মলদ্বারে চাকায় হাওয়া দেয়া পাইপের মাধ্যমে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে ১২ বছরের শিশুশ্রমিক রাকিবকে। তার অপরাধ সে গ্যারেজ মালিকের কাজ ছেড়ে অন্য একটি গ্যারেজে কাজ নিয়েছিল। এ কারণে গ্যারেজ মালিক শরিফ ও তার সহযোগী মিন্টু মিয়া তাকে এ নির্মম কায়দায় হত্যা করেন।
গত সোমবার রাতে নগরীর টুটপাড়ায় রাকিবকে হত্যা করা হয়। রাকিবের মা এবং প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়রা জানান, রাতে শরিফের গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবকে তিনি ডেকে নেন। একপর্যায়ে রাকিবকে টেনেহিঁচড়ে গ্যারেজে ঢোকায় এবং তার গ্যারেজ ছেড়ে অন্য গ্যারেজে কাজ নেয়ার প্রতিশোধ হিসেবে তাকে মারধর শুরু করেন। এসময় শরিফ গ্যারেজকমী মিন্টুর সহায়তায় তাকে বিবস্ত্র করে তার মলদ্বারে টায়ারে হাওয়া দেয়ার পাইপ ঢুকিয়ে দেন। এতে রাকিবের পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং পরে মারা যায়।
রাকিবের মা জানান, গ্যারেজ মালিক শরিফ তুচ্ছ কারণে প্রায়ই রাকিবকে মারধর করত। সে কারণে রাকিব শরিফের গ্যারেজ ছেড়ে কিছুদিন আগে নাসিরের গ্যারেজে কাজ নিয়েছিল।
হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে হত্যা : সিলেটে রাজন হত্যার পর ফেসবুকে গত ১৩ জুলাই প্রকাশ করা হয় শিশু হত্যার নির্মম আরেকটি ঘটনা। এ ক্ষেত্রে ঘটনার শিকার শিশুটির নাম নিজামউদ্দিন। বয়স ১৪। কবুতর চুরির অভিযোগে তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মৃতপ্রায় করা হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় শিশুটি পানি খেতে চাইলে তার হাত-পা বেঁধে বালু নদীতে ফেলে দেয়া হয়। ডুবন্ত শিশুটির দিকে তাকিয়ে এ সময় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ঘাতকেরা।
নিহত শিশু নাজিমউদ্দিনের বাবা সালাম মিয়া জানান, গত ১২ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিল তার ছেলে। ১৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নাজিমউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়। খিলক্ষেত থানার ওসি নজরুল ইসলাম জানান, চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল কথিত কবুতর চুরির অপরাধে নাজিমউদ্দিনেক আটক করে অমানুষিক নির্যাতন চালায় খিলক্ষেতের মস্তুল গ্রামের ৮ থেকে ১০ জন যুবক। এরপর হাত-পা বেঁধে ফেলে দেয়া হয় বালু নদীতে।
গত ৮ জুলাই সিলেটে চুরির অভিযোগে রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করে কয়েকজন যুবক এবং নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার দৃশ্য ভিডিও করার সময় তারাও বারবার ফেটে পড়ছিল পৈশাচিক অট্টহাসিতে।
মাকে দেখতে চাওয়াই ছিল তার অপরাধ : গত ১২ জুলাই চট্টগ্রামে পিকন নামে আট বছরের একটি শিশুকে তার এক আত্মীয় পিটিয়ে হত্যা করে। পিকনের অপরাধ সে তার মাকে দেখতে চেয়েছিল। পিকনের মা সুমী দে সোয়েটার কারখানায় কাজ করতেন। সুমী পিকনকে তার ভাই সুজনের কাছে রেখে কারখানায় যেতেন। মায়ের অনুপস্থিতিতে পিকন অনেক কান্নাকাটি করত এবং সারাদিন মায়ের কাছে যেতে চাইত। ঘটনার আগের দিন পিকন তার মামাকে না বলে বাইরে চলে যায় এবং তাকে কালুরঘাট শিল্প এলাকায় একটি সোয়েটার কারখানার সামনে পাওয়া যায়। যে কারখানার সামনে তাকে পাওয়া যায় সে কারখানায়ই কাজ করতেন তার মা। মামা সুজন তাকে সেখান থেকে ধরে এনে বেদম পিটুনি দেয় এবং পরের দিন মারা যায় পিকন।
২০ জুলাই সাভারে সাগর হোসেন নামে ১০ বছরের এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তুচ্ছ অপরাধে কয়েকজন মাদকাসক্ত যুবক মিলে অসহায় দিনমজুরের শিশুসন্তানটিকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ ছাড়া নওগাঁয় ২৬ জুলাই পাঁচ বছরের এক শিশুকে হাতুড়িপেটা করে হত্যা করা হয়।
পৈশাচিকতার কারণ এক দিনে জন্ম হয়নি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. শাহ এহসান হাবীব বলেন, আজকের এ ঘটনাগুলোর কারণ এক দিনে জন্ম হয়নি। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই প্রতিহিংসা এবং নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সামাজিক বৈষম্য, অন্যায্যতা, দুর্নীতি, বিচারহীনতা এবং অপরাধ করেও শাস্তি না পাওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে তারই ভিন্ন ভিন্ন রূপ এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের সমাজে কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। রাজনীতির ক্ষেত্রেও এটা সত্য। আজকের এ অবস্থার জন্য রাজনীতিও দায়ী।
সামাজিক কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সমাজের আজকের এ চিত্রের পেছনে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা রয়েছে। সিনেমায় সবসময় দেখানো হয় ভিলেনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে কায়দা করে পেটানো হয়। এ জাতীয় আরো অনেক বিষয় রয়েছে যার মাধ্যমে আমাদের তরুণ সমাজ প্রভাবিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, যেসব নির্মম ঘটনা আমরা দেখছি এর ফলে সমাজে আরো বেশি করে নৈরাজ্য, অস্থিরতা, আস্থাহীনতা বাড়বে। আমরা একটি অস্বাভাবিক সমাজে বাস করছি। অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেছি আমরা। অনেক বড় বড় ভুল আমরা করছি। অনিয়ম করে পুরস্কৃত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। আমরা অধপতনের দিকে যাচ্ছি।
একই বিভাগের চেয়ারম্যান এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের বিকাশ হয়েছে এবং হচ্ছে কিন্তু নৈতিকতার বিকাশ হচ্ছে না। আমাদের লক্ষ্য বড় হয়ে টাকা বানাতে হবে। এটা সুস্থ বিকাশ নয়। বস্তুগত উন্নতি আর মানবিক উন্নতির মধ্যে অনেক ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। বৈষম্য বেড়েছে। জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা চলছে। অনেক ক্ষেত্রে বড়রাই নিয়ম মানছে না। আইনের শাসনের অভাবে একজন অপরাধী জানছে তার শাস্তি হবে না। ফলে সে নির্বিঘেœ অপরাধ করছে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলছে। নির্মমতার যেসব চিত্র সামনে আসছে তা ভবিষ্যতের জন্য খুব বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে এম সালাহউদ্দিন বলেন, আমাদের সমাজ থেকে আদর্শবাদ হারিয়ে গেছে। আদর্শবাদের বিকাশ হয়নি। এর ফলেই এসব ঘটনা ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।