ইমাম খাইর, কক্সবাজার :
চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে ফরম সংকটের অজুহাতে ভোটার হতে ইচ্ছুকদের ফেরত দিচ্ছে তথ্য সংগ্রহকারীরা। যাদের ফরম দেয়া হচ্ছে তাদের অনেকের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে টাকা। একই সঙ্গে মোটা অংকের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করারও অভিযোগ ওঠেছে। একাজে তথ্য সংগ্রহকারী ছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে। এ অভিযোগে আজ শুক্রবার সকাল দশটায় জেলা নির্বাচন অফিসে ডাকা হয়েছে অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তাকে। তাদের কাছে উত্থাপিত অভিযোগের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
এ দিকে বাড়ী বাড়ী গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেনা নিয়োজিত ব্যক্তিরা। মহল্লার কোন একটি বাড়ী বা স্কুলের কোনায় বসে দায়সারাভাবে চালিয়ে দিচ্ছে তথ্য সংগ্রহের কাজ। এ নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ কর্মসুচি।
কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর ৬ নং ওয়ার্ডে সুপারভাইজার হিসাবে দায়িত্ব পান মাষ্টার বশির আহমদ। তিনি ডুলাফকির সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার সাথে তথ্য সংগ্রহকারী হিসাবে রয়েছে আরো চারজন।
অভিযোগ ওঠেছে, সুপারভাইজার বশির আহমদ নিজেই টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করাছেন। টাকা ছাড়া ফরম দিচ্ছেন না তিনি। দেখাচ্ছে ফরম সংকটের অযুহাত। পরে টাকা দেয়া হলে মিলছে ফরম।
পূর্ব বামনকাটা এলাকার মনসুর আলম নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, আমি ভোটার হতে গেলে ৭০০ টাকা দাবী করেন বশির স্যার। পরে ৩০০ টাকা দিলে আমাকে ফরম দেয়া হয়। একই অভিযোগ মুরশেদ, ছৈয়দ আলম, ফারুক, জামালসহ অন্তত বিশজন ভুক্তভোগীর।
তবে অভিযুক্ত সুপারভাইজার মাষ্টার বশির আহমদ বলেন, আমি ফরম পূরণের কাজ করিনা। মিল্টন পাল, সেতেরা বেগম, ছৈয়দুল আলম ও কামরুল হাসান তথ্য সংগ্রহ করছেন। এ বিষয়ে তারাই ভাল জানবেন। রোহিঙ্গা ভোটার করা ও ফরমের জন্য টাকা আদায়ের অভিযোগ সত্য নয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য নুরুল আলম লিটন বলেন, এরকম অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, আব্দুর রশিদ নামে এক প্রবাসীর কাছ থেকে ফরমের জন্য ৫ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। বাড়ী বাড়ী গিয়ে ভোটার করার কথা থাকলেও তা মানছেনা তথ্য সংগ্রহকারীরা। দায়সারা দায়িত্ব পালন করছে অনেকেই। ফরম সংকটের কথা বলে লোকজন ফেরত দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন অনেক লোক ফেরত যাচ্ছে।
ইসলামপুর জুমনগরের সমাজ সেবক আবদু শুক্কুর সংবাদকর্মীদের জানান, ফরম সংকটে পড়ে অনেকে ভোটার হতে পারছে না। বিগত হালনাগাদ কার্যক্রমেও ফরম সংকটের কারণে অসংখ্য ভোটারযোগ্য নাগরিক ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। এবারও একই অভিযোগ।
কক্সবাজার পৌরসভার দক্ষিণ কুতুবদিয়া পাড়ার মাষ্টার কামালও রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। একই এলাকার বসবাসরত রোহিঙ্গা মোঃ সালাম পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে ভোটার হওয়ার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে ভোটার নিবন্ধন ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে রোহিঙ্গা মোঃ সালাম বলেন, ‘মাষ্টার চাচা পাঁচ হাজার টাকা লাগবে বলেছে। আমি দুই হাজার টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা পরে দেব বলেছি।’
শুধু রোহিঙ্গা সালাম নয়, এ পর্যন্ত অন্তত ২০ জন রোহিঙ্গাকে ভোটার নিবন্ধন করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে মাষ্টার কামালের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও মাষ্টার কামাল মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, অনেকেই এখনো ভোটার হালনাগাদে অন্তর্ভূক্ত হতে পারেননি। অথচ টাকার জোরে রোহিঙ্গারা ভোটার হয়ে যাচ্ছে। শহরের উত্তর কুতুবদিয়া পাড়াস্থ বেরং পাড়ার বসবাসরত রোহিঙ্গা মোঃ ছৈয়দ মাঝি, মোঃ ইউসুফ প্রকাশ কালু মাঝি ও নবী হোছেন ১নং ওয়ার্ডে ভোটার হতে না পেরে ২নং ওয়ার্ডে গিয়ে ভোটার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিজানুর রহমানকে ম্যানেজ করে ভোটার নিবন্ধন ফরম জমা দিয়েছে বলে জানান উত্তর কুতুবদিয়া পাড়াস্থ বেরং পাড়া সমাজ কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে কাউন্সিলর মিজানুর রহমানকে ফোন করলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
দরিয়ানগরের বড়ছড়া এলাকার সমাজ কমিটির সর্দার মাহবুব আলম জানিয়েছেন, এলাকার কতিপয় অসৎ মানুষের কারণে অনেক রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে। তথ্য সংগ্রহকারীদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেই রোহিঙ্গারা ভোটার হচ্ছে।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ মেছবাহ উদ্দিন বলেন, দুইজনের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে তাদের ব্যাখা চাওয়া হয়েছে। এ জন্য আজ শুক্রবার সকাল দশটায় তাদেরকে জেলা নির্বাচন অফিসে ডাকা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, ২৫ জুলাই থেকে কক্সবাাজার সদর, মহেশখালী ও উখিয়া উপজেলায় ভোটর তালিকা হালনাগাদ হচ্ছে। চলবে ৯ আগষ্ট পর্যন্ত। এসব এলাকায় ১১ আগষ্ট ছবি তোলা হবে। নতুন ভোটারদের প্রত্যেকেই পাবেন ‘স্মার্ট কার্ড’ আকারের আইডি কার্ড। এ ছাড়া রামু, চকরিয়া ও টেকনাফে ১৬ আগষ্ট এবং পেকুয়া ও কুতুবদিয়া উপজেলায় ৩০ আগষ্ট থেকে হালনাগাদ শুরু হবে। প্রত্যেক উপজেলায় শুরুর দিন থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
ফরম সংকটের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেক এলাকায় পর্যাপ্ত ফরম দেয়া হয়েছে। সংকটের কোন কারণ নেই। প্রতিদিন কাজের মনিটরিং করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ফরম সংকটের কথা কেউ আমাদের বলেনি। এরপরও খোঁজ নিয়ে দ্রুত সমাধান করা হবে।
সুসাশনের জন্য নাগরিক সুজনের জেলা সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান বলেন, অতীতেও রোহিঙ্গারা ভোটার হয়েছেন। তাদের সহায়তাকারী হিসাবে ৪০ জন জনপ্রতিনিধিকে সরকারীভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার করা দেশ দ্রেুাহিতার শামিল। এ কাজেদের কঠিন শাস্তি দেয়া দরকার। এছাড়া টাকা নিয়ে ভোটার আবেদন ফরম দেয়া একটি গুরুতর ও নিকৃষ্টতম অভিযোগ। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া চাই।
চলমান নহালনাগাদে প্রথম পর্যায়ে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারী যার বয়স ১৮ বছর হবে তাকে ভোটার তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারী যার বয়স ১৮ বছর হবে তিনিও হালনাগাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। পর্যায়ক্রমে তাদের প্রত্যেককে ভোটার করে নেয়া হবে। এছাড়া সারা বছর নতুন ভোটার হওয়া, ভোটার সংশোধন ও স্থানান্তর করা যায়। জেলা নির্বাচন অফিসে গিয়ে নাগরিত্ব প্রমাণপত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিয়ে এসব কাজ করতে পারেন।
নির্বাচনের অফিসের দেয়া তথ্য মতে, কক্সবাজার সদরে বিদ্যমান ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৯ জন, উখিয়া উপজেলায় ১ লাখ ১১ হাজার ৬৪১ জন এবং মহেশখালীতে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫২ জন।
অভিযোগ রয়েছে, চলতি ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে নতুন ভোটারদের সনদের জন্য ধারস্থ হতে হচ্ছে পৌরসভা ও ইউনিয়ন গুলোতে। আর ওই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ওসব ইউনিয়ন ও পৌরসভা গুলোতে দেদারচ্ছে চলছে জন্ম, মৃত্যু ও জাতী পরিচয়পত্র বানিজ্যের মহোৎসব। চরম দূর্ভোগে পড়তে হচ্ছে ভোটার তালিকা হতে আগ্রহীদের।