আতশবাজি ও উৎসবের বাহারি শব্দ বাংলা-ভারতের সীমান্তের ওপরের আকাশসীমায় মিলিয়ে গেছে। দুই ছিটমহলের বেশির ভাগ মানুষ বুকের ছাতি ফুলিয়ে যার যার মুক্ত স্বাধীন স্বদেশে শ্বাস টেনে নিয়েছেন। ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট ইতিমধ্যে ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসে। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে যায় না। কিছু মানুষের জীবনে কিছু হিসাব বাকি থাকে। এরকমই কিছু মানুষের দেখা পেয়েছেন দি হিন্দুর শিব সাহা সিং। গতকাল তিনি ভারতের কোচবিহারের মশালডাঙ্গা ঘুরে লিখেছেন, বাংলাদেশ ছিটমহলে এমন কিছু ব্যক্তি রয়ে গেলেন, যাদের যাওয়ার কোন গন্তব্য নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সেক্রেটারি কিরিটি রায় গত ২১শে জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, ভারতীয় নাগরিক হতে আগ্রহীদের মধ্যে এভাবে বাদ পড়াদের সংখ্যা ২৯৭। কোচবিহারের ডেপুটি কমিশনার পি. উলগানাথন বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ উভয় সরকার যৌথভাবে মাথা গণনার কাজ শেষ করেছে। এখন আর পেছনে ফেরার উপায় নেই।’
শুক্রবার উদযাপন করবেন বলে অন্যদের মতো তিনিও খাবারের দোকান সাজিয়েছিলেন। তার নাম শহিদুল শেখ। কিন্তু তিনি তাদের একজন, যার নাম সর্বশেষ গণনা করা জনসংখ্যা তালিকায় ওঠেনি। অথচ ২০১১ সালে গণনায় তার নাম যে উঠেছিল, সেই ব্যাজ তিনি আজও বহন করছেন। সেই ব্যাজ দেখিয়ে শেখ বললেন, ‘তালিকায় আমাদের নাম, যে উঠেছিল সেই প্রমাণ আমাদের হাতে আছে।’
মশালডাঙ্গার অন্তত ১০টি পরিবার, যারা স্বাধীনতা উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, তারা হতোদ্যম হলেন, হতাশ হলেন, কারণ তাদের নাম নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্তদের তালিকায় নেই। তারা বাংলাদেশী নয়, ভারতীয় হতে চান।
জাবেদা বেওয়া দি হিন্দুকে বলেন, ‘অনেকেই তাদের বলেছেন, যেহেতু তাদের নাম নেই, তাই তাদেরকে ফিরতে হবে বাংলাদেশেই। কিন্তু আমরা কখনও ভাবতে পারিনি যে, এরকম একটা সময় আমাদেরকে দেখতে হবে।’
শুকুর শেখ এবং এরশাদ শেখ বললেন, ‘নিশ্চয় কোথাও একটা ভুল হয়েছে। না হলে তাদের নাম ভারতীয় নাগরিকদের তালিকায় বাদ পড়ার কোন কারণ নেই।
উল্লেখ্য, দি হিন্দুর ওই সাংবাদিক আরও কয়েকটি ছিটমহলে এরকম বাদ পড়া ব্যক্তিদের সন্ধান পেয়েছেন।
স্বাধীনতার লগ্ন সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যয় ও নমিতেষ ঘোষ লিখেছেন, বাংলাদেশের ছিটমহলে এমন ঘড়ির দুই কাঁটা এক হয়ে যেতেই চিৎকার উঠলো জমায়েতের মধ্য থেকে। শুরু হলো বাজি-পটকার আওয়াজ। মশালডাঙার আকাশ ভরে গেল রোশনাইয়ে। ভারতের জাতীয় পতাকা আগেই অস্থায়ী বেদি তৈরি করে বসানো ছিল। মধ্যরাতের স্বাধীনতায় সেই পতাকা উঠলো আকাশে। জমায়েতের লোকজন আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন। শুধু আসমা নয়, অনেক মানুষেরই চোখে জল। মা-ঠাকুমারা এসেছেন বাড়ির শিশুদের সঙ্গে নিয়ে। কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তারা। আওয়াজে জেগে উঠে তাদের গলাতেও চিৎকার।
দীর্ঘ বাধা টপকে, খানাখন্দ পেরিয়ে স্বাধীনতার ৬৭ বছরে এসে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি শুধু যে ঐতিহাসিক, তা-ই নয়। এ যেন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নতুন সম্পর্কের দিগন্ত খুলে দিলো। বলছিলেন স্থানীয় বয়স্ক মানুষেরা। ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল এদিন মিশে গেল ভারতের সঙ্গে। সরকারি হিসাব বলছে, ১৪ হাজার বাংলাদেশী মানুষ এদিন সরকারি ভাবে নাগরিকত্ব পেলেন ভারতের।
উদ্?যাপনটা অবশ্য শুরু হয়েছিল রাত বারোটার অনেক আগেই। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালামের একটি উক্তিকে দিয়ে তোরণ সাজিয়েছেন এলাকার মানুষ। তাতে লেখা ‘যা ঘুমের মধ্যে দেখো, সেটা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন সেটাই, যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না!’ রাত আটটায় যে অনুষ্ঠান দিয়ে উদ্?যাপন শুরু হলো, তাতে এসেছিল ছিট-শিশু জেহাদ হোসেন ওবামার আখ্যানও। ছিল ছিটমহলবাসীর বাঁধা গান, যাতে সেই যন্ত্রণারই গুনগুনানি। এছাড়া ছিটমহলবাসীর অন্ধকার জীবনের ওপরে ঘণ্টা দুয়েকের একটি তথ্যচিত্র। তার পরেই মধ্যরাতের উল্লাস।
বাজি-পটকার রোশনাই কমে এলে, উচ্ছ্বাস থিতিয়ে এলে ছিটমহল বিনিময় কমিটির নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘অধিকার অর্জনের স্বপ্ন, আত্মপরিচিতির স্বপ্ন সত্যিই এতদিন ঘুমোতে দেয়নি ছিটমহলের বাসিন্দাদের। সেই জয় অর্জনের পরে এবার ওরা শান্তিতে ঘুমোবে।’’
মায়ের সঙ্গে তার আগেই ঘুমোতে গিয়েছে ছোট্ট পাঁচ বছরের ছেলেটি, সে ছিটমহলের (বারাক হোসেন) ওবামা। আজ সকালে তার ঘুম ভাঙবে নতুন দেশে, তার স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।