পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তনের পর লাগা ধাক্কা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। ধারাবাহিকভাবে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। সর্বশেষ প্রান্তিকেও আর্থিক অবস্থার অবনতির ধারা অব্যহত রয়েছে।
একদিকে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা কমেছে, অন্যদিকে দেখা দিয়েছে পরিচালন নগদ অর্থের সংকট। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ ব্যাংকটির চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের তিন প্রান্তিকের মধ্যে সর্বশেষ প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সবচেয়ে কম মুনাফা হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি মুনাফা (সমন্বিত) হয়েছে মাত্র ৩১ পয়সা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৬ পয়সা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় সমন্বিত শেয়ার প্রতি আয় কমেছে ১৫ পয়সা।
প্রতিষ্ঠানটির চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের শেয়ার প্রতি মুনাফা শুধু আগের বছরের তুলনায় নয়, ২০১৫ সালের তুলনায়ও কমেছে। ২০১৫ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি মুনাফা ছিল ৩৩ পয়সা।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন হয়। ওইদিন ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় ব্যাংকটির পর্ষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানও ব্যবস্থাপনা পরিচালকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কিনে ব্যাংকটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চট্টগ্রামভিত্তিক দেশের শীর্ষ পর্যায়ের একটি শিল্প গ্রুপ। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে গ্রুপটি নিজেদের পছন্দের লোক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসায়।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ওই শিল্প গ্রুপটি কুয়েত ফাইন্যান্স হাউজের কাছে থাকা ইসলামী ব্যাংকের ৮ কোটি ৪৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮২টি শেয়ারও কিনে নিয়েছে, যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের সোয়া ৫ শতাংশ। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে গ্রুপটি শেয়ার কিনে নেয়।
নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিনমাস পর পর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়, যা পর্ষদ সভার দিনই অনলাইনে প্রকাশ করতে হয়। যে কারণে ইসলামী ব্যাংকও তিন মাস পর পর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বৃহস্পতিবার কোম্পানিটি চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে এ প্রতিবেদনে কোম্পানির সার্বিক আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়নি। শুধু শেয়ার প্রতি মুনাফা, সম্পদ মূল্য এবং পরিচালন নগদ প্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো’র তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ইসলামী ব্যাংকের সমন্বিত শেয়ার প্রতি মুনাফা হয়েছে ৩১ পয়সা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪৬ পয়সা। শুধু জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে নয় মাসের হিসাবেও কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি মুনাফা কমেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটির সমন্বিত শেয়ার প্রতি মুনাফা হয়েছে ২ টাকা ১১ পয়সা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২ টাকা ৬১ পয়সা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় প্রতিটি শেয়ারের বিপরীত মুনাফা কমেছে ৫০ পয়সা।
এদিকে চলতি বছরের প্রথমার্ধে দেখা দেয়া নগদ অর্থ সংকট থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি ইসলামী ব্যাংক। চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে কোম্পানিটির সমন্বিত শেয়ার প্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ বা শেয়ার প্রতি ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১১ টাকা ৬০ পয়সা।
পরিচালন নগদ প্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ হলো নগদ অর্থের সংকট তৈরি হওয়া। শেয়ার প্রতি ক্যাশ ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক হবে নগদ অর্থের সংকটও তত বাড়বে। এ অবস্থা তৈরি হলে চাহিদা মেটাতে ব্যাংককে চড়া সুদে টাকা ধার করতে হতে পারে। তাতে খরচ বেড়ে যাবে এবং আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
২০১০ সাল থেকে প্রকাশিত কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোম্পানিটি এর আগে কখনো এমন আর্থিক সংকটে পড়েনি। গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ইসলামী ব্যাংকের সমন্বিত শেয়ার প্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ ছিল ২৩ পয়সা।
এর আগে জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ২০১৫ সালে ১৪ টাকা ৪৭ পয়সা, ২০১৪ সালে ২৯ টাকা ৮২ পয়সা, ২০১৩ সালে ১২ টাকা ৬০ পয়সা, ২০১২ সালে ৯ টাকা ৭৬ পয়সা, ২০১১ সালে ১২ টাকা ৯৫ পয়সা শেয়ার প্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ ছিল ব্যাংকটির। অর্থাৎ চলতি বছর বাদ দিলে আর কোন বছরে ব্যাংকটির ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়নি।
এদিকে ইসলামী ব্যাংকের চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের আমানত গ্রহণ ও ঋণ বিতরণ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে গত জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির তৈরি করা আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৪ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের সাড়ে ৫ শতাংশ। আর খেলাপি ঋণের মধ্যে ২ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হামিদ মিয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাদের কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ইসলামী ব্যাংকের চলতি বছরের প্রথমার্ধের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর আরাস্তু খান বলেছিলেন, আমরা কিছুটা নগদ অর্থের সংকটে রয়েছি। এ অবস্থা উত্তরে আমরা চেষ্টা করছি।