মৎস্য বৈচিত্র্যের সবচেয়ে বড় ভান্ডার হাওর অঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও সীমান্তের ওপারের পাহাড়ি ঢলে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বন্যায় মাছের মড়কের কারণ অনুসন্ধান ও নিরীক্ষণের পর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের বিজ্ঞানীরা আজ বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন দিয়েছেন। হাওর এলাকায় মাছের মড়ক সংক্রান্ত সার্বিক পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রিপোর্ট ওই প্রতিবেদন দেন বিশেষজ্ঞ টিম। গত মঙ্গলবার সারাদিন সুনামগঞ্জের হাওরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে নমুনা ও তথ্য সংগ্রহ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে অধিকতর গবেষণার মাধ্যমে ওই প্রতিবেদন তৈরী করেন তারা। প্রতিবেদনের তারা মাছের পূর্বের প্রাচুর্য্য ফিরে পাওয়া চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ৯টি সুপারিশ প্রদান করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. সুভাস চন্দ্র চক্রবর্তীর পৃষ্ঠপোষকতায় বিশেষজ্ঞ টিমের আহ্বায়ক হিসেবে ছিলেন একোয়াকালচার বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক। টিমের অন্যান্য সদস্য হিসেবে ছিলেন একোয়াকালচার বিভাগের প্রফেসর ড. এস. এম. রহমত উল্লাহ, ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. এ. কে. এম. নওশাদ আলম, একোয়াকালচার বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আলী রেজা ফারুক, ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রফেসর ড. মো. শাহজাহান, ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের সহযোগী প্রফেসর ড. এ. কে. শাকুর আহম্মদ।
অনুসন্ধানের ফলাফলে বিশেষজ্ঞরা জানান, গত ১২ চৈত্র বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের ধান তলিয়ে যায়, প্রায় ২২ দিন পর বৈশাখের ৫ তারিখে মাছের মড়ক দেখা দেয়। আগাম বৃষ্টির কারণে অপরিপক্ক ধান বা দুধ-ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে পঁচে যায়, অপরিপক্ক ধানের কার্বোহাইড্রেট পঁচনের জন্য পানিতে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড বেড়ে যায়। এতে করে হাওরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় এবং মাছের মৃত্যু ঘটে। বিশেষজ্ঞ টিমের পরীক্ষা অনুযায়ী হালির হাওরের পানির পিএইচ ও অক্সিজেনের রেঞ্জ যথাক্রমে ৬.৬৬-৬.৮৩ এবং ৪.৩০-৪.৭৬ ছিল যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম। পানির তাপমাত্রা ছিল ২৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং পানিতে কোনো এমোনিয়া ও নাইট্রাইটের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে হাওরের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ধানের পঁচনে বড় মাছের ব্যাপক মৃত্যু হয়েছে কিন্তু হাওরে ১৯ প্রকারের মাছ ও জলজ প্রাণির পোনাও পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণিগুলো হলো টাকি, শোল, চিংড়ি, ভেদা, কই, টেংরা, বাইম, গুচি বাইম, তারা বাইম, কুচিয়া, শিং, গুতুম, পুটি, চেং/রাগা, দারকিনা, কানপোনা, বেলে, কাকিলা, ও ব্যাংাচি।
এত মাছ পাওয়ার কারণ হিসেবে যা জানা গেছে তা হলো, হাওরের পাড় ঘেসে যে সমস্ত খাড়ি ছিল তাতে অনেক ব্রুড মাছ (পিতা-মাতা মাছ) ছিল, সেখানে ধানের পঁচা পানি না ঢুকতে পারাতে ব্রুড মাছগুলো বেঁচে গিয়ে ডিম দিয়েছে এবং পোনা উৎপন্ন হয়েছে প্রচুর পরিমাণে এবং পরবর্তীতে টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে খাড়ি ও হাওর সব একাকার হয়ে যাওয়ায় পোনা মাছগুলো হাওরে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরা এগুলো জাল দিয়ে ধরছে যা পরবর্তীতে মাছের আরো ক্ষতির কারণ হতে পারে।
আরেক বিশ্লেষণে জানা যায়, যে সমস্ত হাওরে হাওরের মোট আয়তনের তুলনায় ধান চাষের জমির আয়তন কম এবং হাওরের গভীরতা বেশি সেখানে মাছের মৃত্যু তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। অন্যদিকে যেসব হাওরের মোট আয়তনের তুলনায় ধান চাষের জমির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি এবং হাওরের গভীরতা কম সেখানে মাছের মৃত্যু বেশি হয়েছে।
মাছের মৃত্যুর পাশাপাশি হাঁসের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা হয়। শুস্ক মৌসুমে হাওরের বোরো ধানক্ষেতে প্রচুর পোকামাকড় জন্মায়, এগুলোর মাঝে অনেক বিষাক্ত পোকামাকড়ও থাকে। হাওরের আকষ্মিক বন্যায় পোকামাকড়গুলো ভেসে হাওরের পাড়ের কাছাকাছি চলে আসে, এতে করে হাঁস সহজে এগুলো খেতে পারে। স্থানীয় জনগণের মতে, পোকামাকড়গুলো থেকে বিষাক্ত পোকামাকড় খাওয়ার কারণে হাঁসের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য কারণেও হাঁসের মৃত্যু প্রায় সারা বছরই কম-বেশি হয়ে থাকে। হালির হাওর থেকে পাওয়া মৃত হাঁসের রক্তের ডিএনএ মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ল্যাবে এনালাইসিস করে রক্তে কোনো বিষাক্ত দ্রব্যের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
হাওরবাসীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ থেকে যা জানা যায় তা হলো, হাওরের সমস্ত ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মানুষ একেবারেই খাদ্যহীন হয়ে পড়েছে, মানুষের ঘরে মজুদকৃত কোন ধান বা খাদ্য অবশিষ্ট নেই। বোরো ধান তোলার পর সারাবছর মাছের ঝোল দিয়ে ভাতই হচ্ছে হাওরবাসীর প্রধান খাদ্য। এদিকে সরকার বা অন্যান্য সংস্থার পক্ষ থেকে চাল বা খাদ্য সহযোগিতার আশ্বাস বা সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ফলে চাল কেনার অর্থ যোগার করতে মানুষ হাওর থেকে মাছ আহরণের চাপ বাড়াচ্ছে, এতে করে হাওরের অবশিষ্ট ব্রুড মাছগুলো কমে যাবে। জামালগঞ্জের মাছের বাজার পরিদর্শন ও স্থানীয় জেলেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হাওরে জেলেরা মাছ পাচ্ছে না, এবং বাজারে মাছের পরিমান আশংকাজনক হারে কমে গেছে।
এদিকে আরেকটি বড় সমস্যা উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ টিম বলেন, এখন থেকে আগামী জুন মাস পর্যন্ত মাছ প্রজনন করবে। এমনিতেই হাওরে প্রজননক্ষম মাছের সংখ্যা কমে গেছে। সেখানে মৎস্য আহরণের চাপ বাড়লে হাওরে মাছের পরিমান দীর্ঘ মেয়াদে কমে যেতে পারে। মাছের পূর্বেকার প্রাচুর্য্য ফিরে পেতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে। এটি হাওর ফিশারিজের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
মৎস্য সম্পদ ও জীব-বৈচিত্র্য সংক্রান্ত এই বহুমুখী ও জটিল সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বিশেষজ্ঞ টিম ৯টি সুপারিশমালা প্রদান করেন। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, হাওরবাসীর আগামী এক বছর খাবারের সংস্থান, সহজ শর্তে ঋন, বিকল্প কর্মসংস্থানের, আগামী তিন মাস হাওরে মাছ আহরণের চাপ কমানোর, হাওর অঞ্চলে খাঁচায় মাছ চাষ সম্প্রসাণ, খাঁচায় মাছ চাষ অত্যন্ত ব্যয়বহুল এজন্য সরকারী বা বেসরকারী সংস্থাগুলো সম্পূর্ণ খরচে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধুমাত্র শ্রম-অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে দুর্যোগ-পীড়িত মানুষদের যুক্ত করে তাদের খাদ্য হিসেবে মাছ যোগান দেয়া ও সামান্য হলেও আর্থিক আয়ের সুযোগ দিয়ে হাওরে মাছের আহরণের চাপ কমানোর জন্য সমাজ-ভিত্তিক খাঁচায় মাছ চাষ লিজের আওতায় থাকা হাওরের বিলগুলো শুকিয়ে মাছ না ধরা, কিছু বড় ও গভীর হাওরকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা, অন্য উৎস্য থেকে গুনগতমানের মাছের রেনু সংগ্রহ করে হাওরে অবমুক্ত করা, অন্তত ৬ মাস মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদপ্তরকে হাওরের মৎস্য সম্পদের সার্বিক অবস্থা নিয়মিত মনিটরিং করার ব্যবস্থা করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেখানে ইন্টারডিসিপ্লিনারি বিশেষজ্ঞ আছে (যেমন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) সেখান থেকে মাৎস্যবিজ্ঞান, পশুপালন বিজ্ঞান, ফসল উৎপাদন বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত দীর্ঘ মেয়াদি গবেষণা প্রকল্প হাতে নেওয়ার বিষেয়ে সুপারিশ করেন তারা।
বিশেষজ্ঞ টিম আরও জানান, হাওরের এ দুর্যোগের পরিণাম এখনই শেষ নয়, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, কারণ বৃষ্টির পরে রোদ্রাবস্থায় ধানের নাড়ার পঁচনে পরিবেশ আরো দূষিত হয়ে মাছের রোগ বা মৃত্যু হতে পারে, এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে বিষয়টি উপর নজরে রাখতে হবে।