নাজমুল হক :
মায়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গারা প্রায় ১১,৫৮,৫৫৫ জন বাংলাদেশে প্রবেশ করে। রোহিঙ্গারা মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের অধিবাসী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি ও গোস্টির মানুষ নিজের দেশে নাগরিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে বসবাস করে আসছে। ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত এবং নিয়াতিত। রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর অত্যাচার হত্যা নিয়াতন ধষনের মোকাবিলা করে বেচে থাকতে হচ্ছে। বিশ্বে অনেক নিযাতিত ও নিপীড়িত জাতির পাশে জাতিসংঘ দাড়িয়ে তাদেরকে নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। একক ভাষাভাষী জাতি হিসেবে রোহিঙ্গারা নিজ দেশের সেনাবাহিনীর অত্যাচারে বিতাড়িত জাতি। তাদেরকে ফেরত নেওয়ার জন্য জাতীসংঘের ভুমিকা খুবই দুবল।
বাংলাদেশ সরকার ২৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য দ্বিতীয় আবাসস্থল নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার ভাসানচরে ১৩০০ একর জায়গায় ১০০,০০০ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রাম তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য ২৩ নভেম্বর ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ১৫ নভেম্বর ২০১৮ এবং ২২ আগষ্ট ২০১৯ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে রারিখ ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক এবং জাতীসংঘের কুটনৈতিক বুদ্ধি বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে নাই। কখন রোহিঙ্গারা মায়ানমার ফেরত যাবে, নাকি ভাসানচর এভাবে বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে!! আন্তর্জাতিক কুটনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতি বলবে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত কি? নাকি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দুঃখ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে!!
বিশ্ববাসী দেখেছে পুব তিমুর এবং সাউথ সুদানের নাগরিকদের রক্ষার জন্য জাতীসংঘের ভুমিকা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। মায়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কোন সামরিক প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী। নিজের দেশের নাগরিকদের সেনবাহিনীর যোন নিপীড়ন গণহত্যা চালিয়ে বিতাড়িত করা একটি মারাত্মক অপরাধ। বাংলাদেশ সরকার মানবতা এবং মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের টেকনাফে আশ্রয় দিয়েছে। যাহা সারাবিশ্বে বিরল ঘটনা।।
নিজের দেশের সেনাবাহিনী দ্ধারা বিতাড়িত জন্মভূমি এবং রাজ্যহারা নিযাযিত রহিংগাদের কথা ভাবতেই কষ্ট হয়। তাদের কোন জাতীয় নেতা নেই, তাদের জাতির কোন নিজস্ব স্বপ্ন নেই, কতদিন তারা এভাবে ত্রিপলের নিচে থাকবে, কে তাদের কান্ডারি, কবে মায়ানমার ফিরে যাবে, কিছুই তারা জানে না। রোহিঙ্গাদের ছোটছোট ছেলে-মেয়ে বা যুবকেরা বেড়ে উঠছে অশিক্ষিত প্রাণী হিসাবে। ওরা যেন মানুষ নয়, বেচে আছে প্রাণী হিসেবে। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা বা চিন্তা করার কোন ধরণের পরিবেশ তাদের মধ্যে নেই।
বাংগিলারা ১৯৭১ এ শরনার্থী হিসেবে ভারতে গিয়েছিল কিন্তু তাদের স্বপ্ন ছিল, দেশ স্বাধীন হবে, তারা নিজ জন্মভূমিতে ফিরে যাবে। কিন্তু রহিংগাদের স্বপ্ন কী, কী তাদের ভবিষৎ, কে তাদের স্বপ্ন দেখাবে? কোন এক সময় হয়ত রহিংগারা মায়ানমার ফেরত যাবে, কিন্তু সেখানেও থাকতে হবে ক্যাম্পে নিজ দেশে নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত পরবাসী নাগরিক হিসেবে । রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে লেখা পড়া ব্যবসা বানিজ্য চাকরির কোন সুযোগ দেওয়া হয় না। তাদেরকে একটা অঞ্চলে ব্লক করে রাখা হয়েছে। চাষাবাদ পশুপালন ইত্যাদি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের ব্যাংক হিসাব খোলার অনুমতি নেই। মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে দেশের সবত্র ব্যবসা বানিজ্য চাকুরী বসবাস করার কোন সুযোগ নেই।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের টেকনাফ এবং উখিয়া উপজেলায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ত্রিপলের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। নাফ নদীর তীর থেকে আরকান বা রাখাইন প্রদেশ দেখা যায়। রোহিঙ্গাদের দেশ মায়ানমার। সামরিক জান্তা তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমাদের দেশের লেখক পত্রপত্রিকায় লিখছে যে রহিংগারা না-কি হিংস্র প্রকৃতির, মারমুখী, চোরাকারবারী ইয়াবা ব্যবসায়ী ইত্যাদি। রোহিঙ্গারা সাধারণত খুবই নীরহ ও শান্ত প্রকৃতির কৃষিজীবি জাতি। নারী বা মহিলারা বোরকা পড়া ছাড়া চলাফেরা করে না। পর্দানশীল নারীরা ২/৩ জন স্ত্রী একসাথে বসবাস করে। ছেলে মেয়ে নারী পুরুষ সবাই একে অপরের দেখা মাত্র সালাম বিনিময় করে। প্রায় সকলেই নিয়মিত নামাজ আদায় করে। ত্রিপলের ঘর তোইরি করার আগে বাশ দিয়ে মসজিদ তৈরী করেছে। রোহিঙ্গারা ৩ শতাধিক মসজিদ তৈরী করেছে। বিতাড়িত রোহিঙ্গারা নিযাতিত অধিকার বঞ্চিত অশিক্ষিত স্তম্ভিত ও নির্বাক জাতি। –
বাংলাদেশের মানুষ যে দরদি মন নিয়ে অন্যের সহযোগিতায় করে তার প্রমান তারা রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে রেখেছে। ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ ও সামাজিক সংগঠন এসেছে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করার জন্য। যে যা পেরেছে তাই নিয়ে রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। রহিংগাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে দেশের মানুষের মধ্যে উদারতা এবং সরকারী প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর যারা নিয়োজিত আছেন তারাও প্রচন্ড আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা শৃংখলা রক্ষার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসমূহকে ত্রাণ কাজে সহযোগিতা করছে।
শতাধিক মানবিক ও উন্নয়ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের সেবায় এগিয়ে এসেছে শুরু থেকেই যা অব্যাহত আছে। হেলথ ক্যাম্প এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ঔষধসহ চিকিৎসা সেবা দিয়েছে। প্রতিদিন খাদ্যের চাহিদা পুষ্টির চাহিদা মেটাতে উন্নয়ন সংস্থাগুলো নিয়োজিত। সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম থাকায় সন্তান প্রসবে সহায়তা করেছে। চাল, ডাল, তেলসহ প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী, পেন্ট, গেঞ্জি লুংগি ও শিশু ও মহিলাদের জামাকাপড় সহ নানা ধরনের সামগ্রী বিতরণ করেছে। রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা খাদ্য পানীয় ও নিরাপত্তা নিয়ে কোন ধরনের সংকট নেই।।
বিগত বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের আচার আচরণ অনেক পরিবতন ঘটেছে। কেউ কেউ মাদক চোরাচালান ব্যবসায় জড়িত।। তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ এখনো পর্যন্ত হয়নি। রোহিঙ্গারা টেকনাফ উপজেলা এবং উখিয়া উপজেলায় স্থানীয় মানুষদের তুলনায় সংখ্যা গরিস্ট। ওদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিলম্বের কারণে টেকনাফ এবং উখিয়া উপজেলায় মানবিক বিপযয় দেখা দিয়েছে। তারা বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ এর সাথে জড়িয়ে পড়ছে। যাহা আমাদের দেশের জন্য মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।। এই বিরাট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের দেশে পাঠণো ছাড়া কোনো বিকল্প কিছু নেই।
উপমহাদেশীয় শক্তি চীন এবং ভারতের আন্তরিক সহয়োগিতা ছাড়া রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর আন্তর্জাতিক কুটনীতি বাধাগ্রস্ত হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মায়ানমারের বিতাড়িত নাগরিকদের ফেরত পাঠানোর জন্য মায়ানমারকে সামরিক, রাজনৈতিক কুটনৈতিক এবং অথনোতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। জাতিসংঘ ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানবাধিকার সংগঠন ভুমিকা জোরদার করতে হবে । মায়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফেরার পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভুমিকা জোরদার করতে হবে। মায়ানমারের বিতাড়িত নাগরিক রোহিঙ্গাদের বাসস্থান যেন বাংলাদেশের দুঃখ হয়ে না দাঁড়ায়। আমরা চাই রোহিঙ্গারা টেকনাফ ভাসানচর থেকে রাখাইনে ফিরে যাবে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।