বিশেষ প্রতিবেদক :
পুলিশের ইয়াবা সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকা বা সহযোগিতার অভিযোগও অহরহ। বিশেষ করে ফেনীতে ৬ লাখ পিচ ইয়াবাসহ পুলিশের এক এএসআই গ্রেফতার ও তার স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দীতে পুলিশের ইয়াবা সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে। মিলছে নতুন নতুন চাঞ্চল্যকর তথ্য। খোদ কক্সবাজার জেলা পুলিশের এসপি, গোয়েন্দা পুলিশের ওসিসহ ২ডজন পুলিশ কর্মকর্তা ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে দৌড়ঝাপ শুরু করেছে এসব অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা ২০লাখ টাকার মিশন নিয়ে ’সাংবাদিক’ ম্যানেজের প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে।
জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি র উদ্দেশ্যে টেকনাফ থানা, উখিয়া থানা, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া থানা ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশে পোষ্টিং নেন অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা। কক্সবাজার জেলায় ‘ভাল থানায়’ পাষ্টিং পেতে প্রত্যেক অফিসারকে ৫ থেকে ৭লাখ টাকা করে দিতে হয়। বিশেষ করে কক্সবাজার ডিবি পুলিশে পোষ্টিং যেন সোনার হরিন। তদবির ও মোটা অংকের টাকা দিয়েই ডিবিতে পোষ্টিং নিতে হতো। টাকা দিয়ে পোষ্টিং নিয়ে পুলিশে থেকেই তারা সিন্ডিকেট করে জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা ব্যবসায়। বিশেষ করে গোয়েন্দা পুলিশের বিরুদ্ধে ইয়াবা বানিজ্যের অভিযোগ সবচেয়ে বেশী। গোয়েন্দা পুলিশের সদ্য বিদায়ী ওসি দেওয়ান আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ৬ জন এসআই, ৮ জন এএস আই ও ৩২ জন কনষ্টেবল ৫টিমে বিভক্ত হয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন। যদিও এটি সাবেক গোয়েন্দা পুলিশের আরেক ওসি একে মন্জুরুল আলমের দেখানো ও শেখানো পথ। কথিত টিমগুলো টেকনাফ সীমান্ত থেকে পুরো ইয়াবা রুটে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতো। অভিযানের সময় পুলিশ কর্মকর্তারা পুলিশের গাড়ি ব্যবহার করতেন না। প্রাইভেট নোয়া, কার ও মাইক্রোবাসে করে গোয়েন্দা পুলিশের এসব কর্মকর্তা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ও মেরিন ড্রাইভ সড়কের চিহ্নিত একাধিক স্থানে অবস্থান নিয়ে ইয়াবা উদ্ধার করতেন। উদ্ধাকৃত ইয়াবার বেশীরভাগ হজম করে হাতেগোনা কয়েকশ জব্দ দেখানো হতো। এভাবে আইনশৃংখলা বাহিনীতে থেকে পুরো কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল কক্সবাজারে গোয়েন্দা পুলিশ ও বিভিন্ন থানায় কর্মরত বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। এসব অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা বেপরোয়া জীবন যাপন করতেন। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, এদের চাকরি হারানো বা শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ভয় ছিল না। কারণ খোদ জেলা পুলিশের অভিভাবক তাদের এসব কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি পুলিশের ইয়াবা বানিজ্যের বিষয়গুলো জানতেন এবং জব্দ করা ইয়াবার গায়েব হওয়া অংশের একটি নিদিষ্ট পার্সেন্টিস তিনি পেতেন। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত একাধিক পুলিশ সদস্য এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কক্সবাজারে কর্মরত পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, পুলিশের ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছে অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা ছিল অসহায়। তাদের আয়েশি চাল-চলন, ব্যয় ছিল চোখে পড়ার মতো। উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারাও এসব জানতেন। এমনকি খোদ পুলিশ সুপারও ইয়াবার প্রতিটি অভিযান থেকে ১০% করে পেতেন। এ কারনেই তাঁরা বহাল তবিয়তে থেকেই এসব অপরাধ করে গেছেন। তাদের জিজ্ঞাবাসাদ করলে এ বিষয়ে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে।
ফেনীতে ৬ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবা সহ র্যাবের হাতে আটক টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই মাহফুজ র্যাবের কাছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেছেন। সিন্ডিকেটে কারা ছিল তাদের নামের একটি তালিকাও দিয়েছেন তিনি। পুলিশের মধ্যে কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশের এএসআই বিল্লাল হোসেন প্রকাশ বেলাল, হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রেঞ্জের কুমিরা ফাঁড়ির এসআই আশিকুর রহমান অন্যতম। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত থাকার সুবাধে গোয়েন্দা পুলিশের সদ্য বিদায়ী ওসি দেওয়ান আবুল হোসেন, এসআই আকরাম, এসআই কামাল আব্বাস, এএসআই মনির, হুমায়ুন, আবুল কালাম আজাদ, মাদবসহ কনষ্টেবলরা ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। এদের মধ্যে এসআই আকরাম, এএসআই মনির সরাসরি ইয়াবা বেচাকেনার সাথে জড়িত ছিলেন। গোয়েন্দা পুলিশের বদলী দু’ অফিসার এসআই আনিছ ও এসআই ইউনুচের বিরুদ্ধেও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তারা যতদিন ডিবিতে ছিলেন ততদিন অত্যন্ত দাপটের সাথে অপকর্ম করে গেছেন। তাদের ওইসব অপকর্মের সুবিধাভোগি ছিলেন তৎকালীন ওসি মনজুর আলম, বর্তমান এসপিসহ পুলিশ প্রশাসনের কমবেশী সবাই।
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, কক্সবাজার থেকে পুলিশের এ সিন্ডিকেটটি মাসে অন্তত ৫০ লাখ ইয়াবা দেশের
বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার করেছে। সিন্ডিকেটের বেশির ভাগ সদস্যের বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। বিপুল ইয়াবাসহ আটক মাহফুজের বাড়ীও কুমিল্লা জেলায়। মাহফুজ ২০১৩ সালে কক্সবাজার থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন। এর আগে দুই বছর তিনি কক্সবাজার জেলা পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থানার মিরপুর গ্রামে। মাহফুজ বেশির ভাগ সময় কর্মরত ছিলেন ইয়াবা পাচারের অন্যতম রুট কক্সবাজারের টেকনাফ থানায়। এ কারণে পুলিশের মধ্যে এই সিন্ডিকেটের নাম কুমিল্লা সিন্ডিকেট হিসেবেও পরিচিত। কক্সবাজারের জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও টেকনাফ থানায় বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা মিলে গড়ে তুলেছেন এ সিন্ডিকেট।
জানা গেছে, ইয়াবাসহ ধরা পড়ার পর র্যাবের কাছে মাহফুজ স্বীকার করেছেন তিনিসহ পুলিশের অন্তত ছয় কর্মকর্তা ইয়াবা পাচারের সঙ্গে যুক্ত। মাহফুজ ইয়াবাগুলো নিয়েছিলেন হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রেঞ্জের কুমিরা ফাঁড়ির উপপরিদর্শক আশিকুর রহমান ও কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক মো. বেলালের কাছ থেকে। র্যাবের করা মামলায় মাহফুজের সহযোগী হিসেবে বেলাল ও আশিককেও আসামি করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় কক্সবাজারে ইয়াবা আটক করেছেন এই সিন্ডিকেটের পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা আটক করলেও তাঁরা অল্প পরিমাণ জমা দিয়েছেন পুলিশ বিভাগে। বাকি ইয়াবা নিজেরা বিক্রি করার জন্য সেগুলো কক্সবাজারে ভাড়া বাসায় নিয়ে মজুদ করতেন। কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল জোনে বিলাসবহুল হোটেল ও রিসোর্টে রুম ভাড়া নিয়েও সেখানে ইয়াবা মজুদ করতেন তাঁরা। এই মজুদ থেকে মাসে দুটি চালান ঢাকায় পাঠানো হতো। নিরাপদে ইয়াবার চালান ঢাকায় আনতে ব্যবহার করা হতো পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি।
জানা গেছে, পুলিশ লেখা ব্যক্তিগত গাড়ি দেখলে রাস্তায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ তল্লাশি করত না। ফলে সহজেই ইয়াবা পৌঁছে যেত ঢাকায় নির্দিষ্ট ইয়াবা ব্যবসায়ীদের হাতে। মাহফুজ র্যাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তাঁরা নিয়মিতভাবে ইয়াবা পাচার করতেন। কক্সবাজার থেকে এএসআই বেলাল ইয়াবা সংগ্রহ করে তাঁর (বেলালের) মালিকানাধীন মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় নিয়ে যেতেন। আর মাঝেমধ্যে কক্সবাজার যেতেন মাহফুজ।
পুলিশের ইয়াবা পাচারে জড়িত থাকার ব্যাপারে জানতে চাওয়ার জন্য কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে তিনি বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পুলিশের যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তা তদন্ত করা হচ্ছে। ইয়াবা পাচারে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
প্রসঙ্গত, গত ২০ জুন রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী বাইপাস অংশের লালপুল থেকে ৬ লাখ
৮০ হাজার ইয়াবা সহ পুলিশের এসবির এএসআই মাহফুজুর রহমান ও তার গাড়িচালক মো. জাবেদ
আলীকে আটক করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে মাদক বিক্রির নগদ সাত লাখ টাকা, চারটি
মোবাইল সেট, বিভিন্ন ব্যাংকের আটটি ক্রেডিট কার্ড ও তিনটি মাদক বিক্রির টাকার হিসাবের নোটবুক উদ্ধার করে র্যাব। এ ঘটনার পর ইয়াবা পাচারের ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। যার প্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দফতর দুইটি পৃথক কমিটি ঘটনা করে বিষয়ের তদন্ত শুরু করে।
এদিকে, ফেনীতে সাত লাখ ইয়াবাসহ পুলিশের এক কর্মকর্তা আটকের ঘটনায় কক্সবাজারের একজন
পরিদর্শককে ক্লোজড ও ১০ উপ পরিদর্শককে বদলি করা হয়েছে। ২য় দফায় আরও ৩ এএসআই ও ৩ কনষ্টেবলকেও বদলী করা হয়। জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি দেওয়ান আবুল হোসেনকে ক্লোজড করে চট্টগ্রাম রেঞ্জে বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ইয়াবা মামলার আসামি বিল্লাল হোসেনকে ফেনী, উপপরিদর্শক (এসআই) একরামুল হককে খাগড়াছড়ি, উপ পরিদর্শক (এসআই) মনিরুল ইসলাম ভূঞাকে রাঙামাটি, উপ পরিদর্শক (এসআই) মো. আমীরকে নোয়াখালী, কুতুবদিয়া থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) এবিএম কামালকে রাঙামাটি, কক্সবাজার সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কামাল হোসেনকে চাঁদপুর, উপ পরিদর্শক (এসআই) মাসরুরুল হককে লক্ষ্মীপুর, মো. ফিরোজ আলমকে রাঙামাটি, টেকনাফ থানার সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই) সেলিম ও উখিয়ার উপ পরিদর্শক (এসআই) সেলিমকে লক্ষ্মীপুরে বদলি করা হয়েছে।
এদিকে ফেনীতে ৬ লাখ ৮০ হাজার পিচ ইয়াবার চালান নিয়ে পুলিশের এ,এস,আই মাহফুজুর রহমানকে আটকের ঘটনা তদন্তের জন্য সিআইডির ডিআইজি সাইফুল হকের নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের তদন্ত দল তদন্ত শেষে আজ ভোরে ফিরে গেছেন। মঙ্গলবার পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের দলটি তদন্তের জন্য কক্সবাজারে এসে পৌঁছেন। তদন্ত দলটি কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) অফিসের কর্মকর্তা ও কনষ্টেবলদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন।