মহাসড়কে ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে কিছু সংখ্যক পুলিশের ওসি-এসআই! ডাকাতদের ৪০ জনের সিন্ডিকেটকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে ডাকাতির কাজে সহায়তা করে আসছিলেন অসাধু এসব পুলিশ কর্মকর্তা। মহাসড়কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কে কোথায় অবস্থান করছে, তা জানিয়ে দিতেন সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত এসব পুলিশ সদস্য। ডাকাতদের সোর্স হিসেবে বন্দর-কাস্টমসেও কাজ করছেন কিছু কর্মচারী। বন্দরে পণ্য ওঠানোর সময়ই ডাকাতদের গাড়ির নম্বর, রুট ও অন্যান্য তথ্য জানিয়ে দিতেন তারা। এভাবে পরস্পরের যোগসাজশে মহাসড়কে পণ্য লুট হওয়ার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে প্রকৃত অপরাধীরা। ডাকাত ও পুলিশের সংঘবদ্ধ চক্রটি এভাবে গড়ে তুলেছে বিপুল বিত্তবৈভব। ডাকাতদের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। পাশাপাশি বিশেষ রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এবং পুলিশ সুপারের কার্যালয়েও।
বিষয়টি স্বীকার করে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি পাওয়ার পর কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে এরই মধ্যে বদলি করা হয়েছে। ডাকাত ও ছিনতাইকারী চক্রের সক্রিয় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ সুপার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যারা অপরাধ করে, তাদের হাত অনেক লম্বা।
বন্দর থেকে পণ্য লোড করার সময় ভেতর থেকে তথ্য পেয়ে তারা গাড়িকে টার্গেট করে। অনেকে গাড়িটিকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য পর্যন্ত অনুসরণ করে। কিছু পুলিশ এ কাজে সহায়তা করছে_ এমন অভিযোগ এসেছে। এরই মধ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রমও।
ডাকাতদের সহযোগী ওসি-এসআই-ক্যাশিয়ার
পুলিশের সঙ্গে ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের এমন সখ্য রোধ করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো বিশেষ এ রিপোর্টে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া এবং জড়িতদের নিজ নিজ এলাকার বাইরে বদলি করতে বলা হয়েছে। আবার পুলিশের সহযোগী হয়ে যারা এরই মধ্যে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত পাঁচ বছরে মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে মনিটরিং সেল গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে রিপোর্টে। বিশেষ এ রিপোর্টে একজন ওসি, সাতজন এসআই ও একজন ক্যাশিয়ারের নামে উল্লেখ আছে।
‘জ’ আদ্যাক্ষরের সাবেক একজন ওসি ছাড়াও ডাকাতদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ফাঁড়ির এসআই এনাম, হাটহাজারী থানার এসআই কাউসার, পতেঙ্গার এসআই মনির, বন্দর থানার এসআই এনাম, ডবলমুরিং থানার এসআই প্রিটন সরকার, বাকলিয়া থানার এসআই আবদুর রব, আকবরশাহ থানার এসআই শাহীন আকবর ও ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের ক্যাশিয়ার জিয়া। তাদের মধ্যে কুমিল্লার এসআই এনামের সঙ্গে আবার ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য সিলেটের সাঈদের যৌথ ব্যবসা রয়েছে। কাভার্ডভ্যান ডাকাতি করা বাচ্চুর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের ক্যাশিয়ার জিয়ার। ডাকাত ও ছিনতাইকারী এ চক্রে সরাসরি যুক্ত আছে নগরীর কদমতলীর মুক্তার কমিশনারের ছেলে সোলায়মান মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন রাজীব, বরিশালের হুমায়ুন কবির বাচ্চু, লক্ষ্মীপুরের রামগতির ফাহিম ওরফে সম্রাট ফাহিম, লক্ষ্মীপুরের শাহাদাত, ঢাকার খিলগাঁওয়ের জান্নাত, নারায়ণগঞ্জের এমদাদ হুজুর, কুমিল্লার কাটিয়া গ্রামের মৃত আবদুল হাকিমের ছেলে সোহাগ ওরফে নবী সোহাগ ওরফে নবী নেওয়াজ, সুমন ওরফে বুড়ির ছেলে কেরানীগঞ্জের মুস্তাকিম, বিলাল ওরফে গাজী বিলাল, কুমিল্লার মিয়ার বাজারের খোকন, নোমান, মাসুদ ওরফে কাটিং মাসুদ, ঢাকাইয়া মনির ও মাকছুদ মোহাম্মদ। তাদের সঙ্গে আরও আছে ইসমাইল, জাহাঙ্গীর, নোয়াখালীর বেলাল, ল্যাংড়া মালেক, সিলেটের সাঈদ, বেপারীপাড়ার সাজ্জাদ, নূর মোহাম্মদ, আরাফাত, হালিশহর মইন্যাপাড়ার হায়দার ও পাইকপাড়ার রাশেদ।
যেভাবে হয় ডাকাতি ও ছিনতাই
জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার মহাসড়কে গার্মেন্ট পণ্যবাহী গাড়ি ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ৩০-৪০ জনের একটি সিন্ডিকেট। মিরসরাই থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত কখনও ড্রাইভার ও হেলপারকে ম্যানেজ করে, আবার কখনও বা তাদের জিম্মি করে গার্মেন্ট পণ্যবোঝাই কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক ছিনতাই করা হয়। ছিনতাইকৃত মালামাল এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে নিরাপদে তুলতে ফেনীর বিসিক, মুহুরীগঞ্জ, কুমিল্লার জগন্নাথ দীঘিরপাড়, নারায়ণগঞ্জের রূপসী দীঘিরপাড়ে ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে কিছু ডিপো রয়েছে। এসব ডিপোতে বিশেষ উপায়ে কার্টন থেকে পণ্য বের করে শূন্যস্থানে গার্মেন্ট ঝুট দিয়ে তা পূরণ করে আগের চেহারায় নিয়ে আসে তারা। আর যারা ডাকাতির ঘটনায় যুক্ত, তারা চালককে খুন করে কিংবা অজ্ঞান করে গাড়ির পণ্য ডাকাতি করে। এ সময় এক গাড়ির পণ্য আরেক গাড়িতে সরিয়ে নিতে শ্রমিক কিংবা বিকল্প গাড়িও প্রস্তুত রাখে তারা। যাত্রীবাহী গাড়ি ডাকাতির সময়ও প্রস্তুত থাকে বিকল্প যান। লুট হওয়া পণ্যসহ বিকল্প সেই গাড়িতে উঠেই দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে ডাকাতরা।
ডাকাতি করেই অনেকে হয়েছে কোটিপতি
মহাসড়কে ছিনতাই ও ডাকাতি করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন অনেকেই। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন পিচ্চি মাসুদ। পুলিশ বলছে, কোটিপতি এ ডাকাতের আছে পাঁচটি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান। ঢাকার বসুন্ধরায় রয়েছে তার বাড়ি। আছে নিজস্ব প্লটও। চট্টগ্রাম বন্দরের খালাসি পদে চাকরি করতেন পিচ্চি মাসুদের বাবা মোতাহের হাওলাদার। বাবার টাকায় কোনোমতে চলত তাদের সংসার। প্রথমে মাসুদ কুলির কাজ নেয় মাদারবাড়ী এলাকায়। তবে কাভার্ডভ্যানের মালপত্র ডাকাতি করে পাঁচ বছরের মধ্যেই কুলি থেকে কোটিপতি হয়ে যায় মাসুদ। অন্যের গাড়ি থেকে মালপত্র চুরি করা মাসুদ নিজেই এখন কাভার্ডভ্যানের মালিক। নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার এস এম তানভীর আরাফাত জানান, পিচ্চি মাসুদের ঢাকার বসুন্ধরায় ১০ শতক ও হালিশহর তাসফিয়া কমিউনিটি সেন্টারের কাছে প্রায় ২০ শতক জমি রয়েছে। নগরীর ফইল্যাতলী বাজার ও কুমিল্লায় রয়েছে তার দুটি দ্বিতল ভবন। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্য আনা-নেওয়া করে তার তিনটি কাভার্ডভ্যান। সম্প্রতি একটি শাটারগান, দুই রাউন্ড গুলিসহ তাকে তৈরি পোশাকবাহী একটি গাড়ি ছিনতাইয়ের সময় গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মামলা আছে।