আব্দুল্লাহিল আমান আজামী :: আজ ৮ই জুলাই ২০১৫, ২০শে রমযান। অনেক ঈমানদার ব্যক্তি আজ ইফতারের পূর্বেই মসজিদে ঢুকে যাবেন ১০ দিনের (চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে ৯ দিনও হতে পারে) ই’তেকাফ এর জন্য। বহু বছর আব্বাও প্রতি বছর ই’তেকাফ করেছেন একনিস্ঠভাবে। জীবনের শেষ তিন বছর (২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪) কারারুদ্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এছাড়া, ১৯৯২ এবং ১৯৯৩ সালেও কারাবন্দী থাকায় তিনি ই’তেকাফ করতে পারেন নি। প্রতি বছর ২০শে রমযান এলেই খুব মনে পরে উনার কথা।
আব্বা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত বাধ্যতামুলক নির্বাসনে থাকার পর জুলাই ১৯৭৮’এ দেশে ফিরে আসার পর থেকে ২০১৪ পর্যন্ত এই ৩৬ বছরে দুই দফায় ৫ বছর কারান্তরীণ থাকায় ঐ ৫ বছর ছাড়া যদ্দুর মনে পরে, বাকি ৩১ বছরই তিনি ই’তেকাফ করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। ২০শে রমযান আসরের পর তিনি ই’তেকাফে চলে যেতেন এবং শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে, অর্থাৎ শেষ রমযানের ইফতারের পর বাসায় ফিরতেন। উনার সাথে ই’তেকাফ করার জন্য দেশ ও বিদেশ থেকেও অনেকে এসে যোগ দিয়েছেন।
উনার মত এত কঠিণভাবে সুসৃংখল জীবনযাপন আমি আমার জীবনে কাউকে দেখিনি। ই’তেকাফেও উনার রূটিন ছিল সেট করা। সকালে ঘুম থেকে উঠতেন সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে। এরপর দুই ঘন্টা (১০-১২) পড়ালেখা করতেন। উনার পড়ালেখা বলতে – কোরআন তিলাওয়াত, অর্থ ও তাফসীর অধ্যয়ন, হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য পাঠ, বই লিখা এবং পবেষণামুলক পড়া ও লেখা ইত্যাদি সবই সামিল ছিল।
১২টার সময় উনি গোসলে যেতেন। আমার মা এর কাছে শুনেছি, আব্বা জীবনে কোনদিন গোসল বাদ দেন নি। শীতের দেশে বরফ পরার সময়ই তিনি গোসল বাদ দেন নি। উনার রুটিন জীবনের পাশাপাশি দৈনিক গোসলের জন্যই বোধ হয় ৯২ বছর বয়সে ইন্তেকালের সময়ও তিনি আল্লাহর রহমতে কোন ধরণের জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন না। যা হোক, গোসল সেরে ১২ঃ৪৫ এর মধ্যেই তিনি নামাযের জন্য প্রস্তুত। ১টায় জামাত সেরে, সুন্নত নামায এর পর আবার পড়ালেখায় বসতেন তিনি। আসরের পূর্ব পর্যন্ত কেবল নামাযের আগের ঘন্টাখানেক ঘুমাতেন, এছাড়া বাকি সময়টুকু পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্তও আবার পড়াশুনা করতেন, তবে ঐ সময়টাতে কোরআন পড়তেন বেশী। ইফতার করতেন খুব হাল্কা – খেজুর, শরবত, দূ’একটা পিঁয়াজু, বেগুনী, অন্য কোন ফল থাকলে সামান্য। মাগরিব পরেই তিনি খাবার খেতেন – ভাত, সব্জী, ভাজি, ভর্তা, ছোট মাছ ইত্যাদি। খুব পরিমিত পরিমাণ খেতেন তিনি। খাবার খেয়েই বিশ্রাম নিতেন এশা/ তারাবীহ’র পূর্ব পর্যন্ত। এশা আর তারাবীহ শেষ করে একটু হালকা নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়ে পরতেন। ফযরের দুই থেকে তিন ঘন্টা আগে উঠে যেতেন। সেহরী খেতেন ফযরেরে প্রায় ৪৫ মিনিট পূর্বে। এর পূর্ব পর্যন্ত তাহাজ্জুদ এবং তিলাওয়াত করতেন। সেহরী শেষ করে ফযরের পূর্ব পর্যন্ত আবারও তিলাওয়াত করতেন। একদম ছকে বাঁধা ছিল উনার সারাটা জীবন।
উনি যে কয়দিন ই’তেকাফ করতেন, আমি প্রতিদিন উনার সাথে ইফতার করতে যেতাম। বাসার ইফতার ছাড়াও এখানে আমাদের আশেপাশে অন্যান্য ঘনিস্ট আত্মীয়রাও আব্বার জন্য নানান রকমের ইফতার পাঠাতো। আমি অবশ্য ঐ খাবারের জন্য যেতাম না, যেতাম আব্বাকে সংগ দেয়ার জন্য।
সামরিক জীবন শেষে ২০০৯ থেকে ২০১১ এই তিন বছর আমিও শেষ তিনদিন উনার সাথে ই’তেকাফ করেছি। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে ঐ দিনগুলোর। সেহরী ও ইফতারের সময় যারা উনার সাথে খেতে বসতো, উনি খেয়াল করতেন কে কি খাচ্ছে। একে ওকে এটা ওটা নিতে বলতেন, এগিয়ে দিতেন। এমন কি উনার খাদেম যেই ছেলেটা ছিল, তাকেও একসাথে নিয়ে শুধু যে বসতেন তা নয়, বরং নিজ হাতে এটা ওটা উঠিয়ে দিতেন। সমাজের অসহায়, সুবিধা বঞ্চিত, দরিদ্রদের ব্যাপারে উনার সব সময়ই সযত্ন খেয়াল বেশী ছিল।
উনার প্রতিটি কথা, কাজ, আচরন ছিল সকলের জন্য অণুকরনীয়। মহান আল্লাহ তাঁর এই মুখলিস বান্দাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে আবাস করে দিবেন, এই দোয়া করি। আপনাদের কাছেও এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিটির জন্য দোয়া চাই।
নোটঃ ২০১১ সালে উনার জীবনের শেষ ই’তেকাফের এই ছবিগুলো আমার তোলা।