এই নদের তীরেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কালজয়ী, কালোত্তীর্ণ ক্ষুরধর মষি, সার্দূল শব্দের মহানায়ক, অমৃতাক্ষর ছন্দের যাদুকর, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক মহারথী মাইকেল মধুসূদন দত্ত। হে বাকরুদ্ধ কপোতাক্ষ নদ। তুমি আজ কালের আবর্তে অন্ধ, বধির, নির্বাক, তুমি যৌবনহীন পড়ন্ত বিকালের তেজহীন সূর্য। এককালে ছিলে তুমি প্রমত্ত উত্তাল, দূ’কূলে ছিল প্লাবন, এখন গতি মন্থর হৃদয়ে তোমার অজস্র কচুরীপানার আস্তরণ। তুমি শক্তিহীন বৃদ্ধ সিংহের মত দূর্বল তোমার অস্তিত্ব। তোমার হৃদয়ের পুঞ্জিভূত ব্যথা বুঝবার মত নেই কোন মানবাধিকার সংস্থা, নেই কোন রাজাধিরাজ। মানব সভ্যতার এ যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশে সরকারের একটু প্রচেষ্টায় ফিরে পেতে পারে কপোতাক্ষের হারানো গতি ও তার দূরন্ত যৌবন। কপোতাক্ষকে চেনে নাই, জানে নাই এমন কোন দেশ-মহাদেশ নাই। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কপোতাক্ষকে করেছিল বিশ্ববিখ্যাত। মহাকাব্যে গ্রন্থ ‘মেঘনাদ বধ’ সনেট কবিতাখানি কপোতাক্ষ নদ। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে চরম দূরাবস্থার মধ্যেও ভুলে যায়নি শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত মাতৃদুগ্ধ স্বরুপ কপোতাক্ষ নদের কথা। তাইতো কবি লিখেছিলেন “সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমারই কথা ভাবি এ বিরলে” তোমার বুকে মাঝিমাল্লারা গাইত মুর্শিদী, জারি-সারি, ভাটিয়ালী গান, বঙ্গোপসাগর থেকে মাঝে মাঝে তেড়ে আসত বান। সে কি ভয়ানক তুফান। পাল তোলা ডিঙি নৌকাগুলো উজান আর ভাটির টানে বয়ে চলত অবিরাম। শরতে দু’কূলে কাশফুল দুলে যেত, কি অপূর্ব নয়াভিরাম। আজ সেই তুমি, সময়ের কাল পরিক্রমায় বিদীর্ণ হয়ে পড়েছে তোমার দু’কূলে আজ স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। তুমি আজ জৌলুসহীন, রোগাক্রান্ত, রুগ্ন, প্রেগবীদ্ধ ইদূর। তোমার এমনি ভগ্নদশার কারণে ধুকে ধুকে মরতে বসেছে দু’পাড়ের অসহায় জনবসতি। এখন আর কৃষকের জমিতে সোনার ফসল ফলে না, কৃষকের আঙিনা ভরে উঠে না, আমন আর বোরো ধানের মৌ মৌ গন্ধে, অনাহারে, অর্ধাহারে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চায় কপোতাক্ষের কোলঘেষা গ্রামবাসী। বর্ষা মৌসুমে বাস্তুভিটা তলিয়ে যায় রুগ্ন কপোতাক্ষের ভরাটের কারণে। বছরের অধিকাংশ সময় গৃহহারা, সংসার ছাড়া হয়ে পড়ে লাখো লাখো জনবসতি, গবাদিপশু। নিরুপায় হয়ে পৈতৃক ভিটামাটি ছেড়ে ঠাই নিতে হয় কোন আশ্রয়কেন্দ্র অথবা, রাস্তার ধারে ছোট ছোট খুপড়িতে। তখন এসব অসহায় বানভাসি মানুষের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য থাকে না। সবাই মানবেতর জীবনযাপন করে। চেয়ে থাকে সরকারি সাহায্য প্রাপ্তির আশায়। কিন্তু ত্রাণ সামগ্রী প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তারপরেও এসব ত্রাণ সামগ্রীর সিংহভাগ চলে যায় কর্তাব্যক্তিদের নিজস্ব গোডাউনে। তখন জীবন মৃত্যুর মহা সন্ধিক্ষণে দুর্দশাগ্রস্থ মানুষগুলো কচু শাক, কলার থোড় খেয়ে সাপ আর বিষাক্ত পোকামাকড়ের সাথে যুদ্ধ করে করুণভাবে বেঁচে থাকে। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির অভাবে শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়, বৃদ্ধি পায় আমাশয়, টাইফয়েড, কলেরার মত মহামারী। অসহায় জনবসতি বুক ভরা আশা নিয়ে বসে থাকে ক্ষমতা পরিবর্তনের পালাবদলের প্রতীক্ষায়। রাজনৈতিক নেতারাও আশস্থ করে। কিন্তু পরিবর্তন হয়না ভুক্তভোগী জনগণের ভাগ্য। পরিবর্তন হয় না মধু কবির স্মৃতি বিজরিত কপোতাক্ষ নদের স্রোতধারা। শুনতে পায় না কেউ জরাজীর্ণ কংঙ্কালসার কপোতাক্ষের ককিয়ে উঠা শিশুর মত বেদনার নীল আর্তনাদ। ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, কোটি কোটি টাকা বাজেটও আসে কিন্তু কাজ হয় কাগজ কলমে নামকাওয়াস্তে। ঘোলা জল কাঁদা করে চলে যায়, রয়ে যায় কপোতাক্ষের কান্না। এ কান্নার শেষ কোথায় ! হায়রে কপোতাক্ষ তোমার দুঃখের সীমা নেই। এক দিকে ভারতের পানি চুক্তি, ফাঁরাক্কা বাঁধ নীতি, আমাদের অসাবধানতা অপরিকল্পিত কালভার্ট, ব্রীজ, সেতু নির্মাণ, ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন আর রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণেই নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতিটি নদী আজ অর্ধমৃত, প্রায় মৃত অবস্থায় বিদ্যমান। এহেন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনতিবিলম্বে সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। নইলে অতিশীঘ্রই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বাংলাদেশের ভূখ- চিরতরে হারিয়ে যাবে, তলিয়ে যাবে কিয়াদংশ বঙ্গোপসাগরে, বাকী অংশে সৃষ্টি হবে নতুন এক সাহারা মরুভূমি, মরু উদ্যান। প্রবন্ধকার, প্রভাষক বিএম সিরাজ, কাজীরহাট ডিগ্রী কলেজ