সাড়ে ৫ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধস্ত, ভেঙ্গে গেছে সড়ক ও বেড়িবাঁধ
এ.এম হোবাইব সজীব, চকরিয়া :
দীর্ঘদিন পর মেঘাচ্ছন্ন আকাশে দেখা দিল সূর্যের রশ্মি। শনিবার থেকে থেমেছে বৃষ্টি। কিন্তু এখনো কক্সবাজারের চকরিয়ায় অর্ধ শতাধিক গ্রাম পানির নিচে অথৈ জলে ভাসছে। শনিবার সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি থামায় কিছু কিছু এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু হলেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা দুর্ভোগ। ত্রাণের জন্য হাহাকারের পাশাপাশি নানা রোগ-বালাই’র সৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে-দ্বিতীয় দফা বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে চকরিয়া উপজেলায় ৮টি ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এসব ইউনিয়নে সড়ক, গ্রামীণ সড়ক, বেড়িবাঁধসহ ভেঙ্গে গিয়েছে নানা অবকাঠামো, ভেসে গেছে কোটি টাকার মাছ।
টানা ১০ দিন পর উপজেলার চকরিয়ার বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। উপজেলার পুর্ব অংশে বন্যার পানি নেমে গেলেও এখনো পানিবন্দি রয়েছে উপকুলীয় কোনাখালী, বিএমচর, পুর্ববড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, বদরখালী ও পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের অধিবাসিরা। এ ৬ ইউনিয়নে বন্যার পানি নামতে তাকলেও একদিকে বানের পানি, অপরদিকে সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি আতংকে রয়েছে। এসব মানুষ খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটের মধ্যেই ভূঁগছে। এতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে বন্যাদুর্গত এলাকায়। এসব দুর্গত জনপদে মানুষের মাঝে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। বন্যাদুর্গত এসব ইউনিয়নে কিছু ঘরবাড়ীর টিউবওয়েল বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এসব গ্রামের শুকনো জায়গার অভাব দেখা দিয়েছে প্রকট। ফলে উপজেলার বন্যদুর্গত এলাকায় রান্নার কাজ করতে পারছেনা হাজার হাজার পরিবার। কারো বাড়ির আশপাশ, কারো বাড়ির ভেতরে পানি আর পানি। এক কথায় কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশে পরিণত হয়েছে। বিগত ৮/৯ দিন ধরে এসব এলাকায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে বহু পরিবার। রাস্তায় পলিটিনের তাবু নিয়ে আশ্রয় নিয়ে ছিল হাজার হাজার পরিবার। পানি নামতে শুরু করায় এসব পরিবার বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো.সাইফুর রহমান জানান, বন্যায় পানিতে তলিয়ে গিয়ে উপজেলার ৪০হাজার একর চিংড়িজোনের প্রায় পাঁচ হাজার মৎস্য প্রকল্প থেকে ভেসে গেছে দুইশত ৬৬ কোটি টাকার মাছ। একই ভাবে গত জুন মাসের বন্যায় উপজেলার চিংড়ি জোনে ১১৭ কোটি টাকার মাছ পানিতে ভেসে যায়।
উপজেলার দরবেশকাটা এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.শহিদুল ইসলাম দৈনিক মুক্তবাণীকে বলেন, জুন ও জুলাই মাসের দুইদফা বন্যার কারনে চিংড়িজোনের অন্তত পাঁচ হাজার মৎস্য প্রকল্প পানিতে তলিয়ে গিয়ে কমপক্ষে হাজার কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। এখানকার চিংড়ি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে ঘের মালিক ও চাষীদেরকে সহজ সর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে মৎস্য চাষী ও চাষকে করমুক্ত রাখতে হবে। সরকার এব্যাপারে ইতিবাচক প্রদক্ষেপ না নিলে মৎস্য শিল্প থেকে অদুর ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবেনা।
জানা গেছে, টানা ৮/৯ দিন ধরে বানের পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা দেখতে সরকারের কোন মন্ত্রীর এখন কোন দেখা পাননি এই উপজেলার অসহায় মানুষ । বন্যাদুর্গত মানুষ, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ চকরিয়ায় বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণা করে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালানোর দাবি তুললেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তা ঘোষণা করা হয়নি। তবে মাঝে-মধ্যে নামে মাত্র কয়েক টন চাল বরাদ্দ দিয়েই প্রশাসন দায়িত্ব শেষ করছে। এই অবস্থার ত্রাণের জন্য চরম হাহাকার চলছে এ উপজেলার বন্যাদুর্গতদের মাঝে। অনেক এলাকায় বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার পরিলক্ষিত হয়েছে। কক্সবাজার জেলা জাতীয় পাটির সাংগঠনিক সম্পাদক বদরখালীর স্থায়ী বাসিন্দা ডা: আলমগীর বলেন, ‘আমার এই বয়সে অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখেছি। প্রতিবছর মাতামুহুরীর ঢলের পানিতে বন্যা দেখা দেয় চকরিয়া। যা সচরাচর হিসেবেই দেখে আসছি ছোটকাল থেকেই। কিন্তু একমাসের ব্যবধানে পর পর তিনটি ভয়াবহ বন্যায় চকরিয়া মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে। একটানা ৮দিন ধরে বানের পানিতে ভাসতে থাকা মানুষগুলো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটের মধ্যেই দিনাতিপাত করছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে চকরিয়া বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণা করে ব্যাপক পরিসরে ত্রাণ তৎপরতা চালানো।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম বলেন, বন্যার কারনে উপজেলার আঠার ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় সাড়ে পাঁচ হাজার সম্পুর্ণ ও ৩৪হাজার ৪৫০টি কাঁচাঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পানিতে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে এলজিইডি ও সড়ক বিভাগের সড়ক-উপসড়ক। তিনি বলেন, রোববার থেকে বন্যার পানি বিভিন্ন এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গতদের পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।