এ.এম হোবাইব সজীব, কক্সবাজার আলো :
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিশেষ অভিযানের ধারাবাহিকতায় স্থিমিত হওয়ার সুযোগে কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়ায় প্রায় অর্ধশত তালিকাভুক্ত মানবপাচারকারী দুর্বৃত্তরা সম্প্রতি বাড়ি ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বিশেষ অভিযানে ভাটা পড়ায় তাদের অনেকের সুদিনে দিন কাটাচ্ছে বলে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে। এতে করে এলাকার স্বজনহারা ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ উৎকন্ঠা। তাদের দাবি, এসব মানুষ নামের অমানুষ প্রতিশোধের নেশায় প্রতিবাদী স্বজনহারাদের যে কোন সময় বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে। একটি বেসরকারী জরিপে উঠে এসেছে, চকরিয়া-পেকুয়ার উপকূলীয় এলাকা দিয়ে প্রায় ১০/১৫ হাজার স্কুল ছাত্র, কিশোর, যুবকও প্রাপ্ত বয়স্ক সাগর পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। এ সময় বিভিন থানায় দুই উপজেলার দেড়ডজন খানিক মানবপাচারকারীদের আসামী করে মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে ডজন খানিক মামলা রুজু হয়েছে।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এ সময় চিহ্নিত মানবপাচারকারীদের আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অধিকাংশ মানবপাচারকারী জামিনে বেরিয়ে এসেছে। টেকনাফও উখিয়া থানা পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় বাঘা-বাঘা তালিকাভূক্ত মানবপাচারকারী মারা যাওয়ার পর চকরিয়াও পেকুয়া থানার তালিকাভূক্ত মানবপাচারকারী আসামীরা আত্মগোপন করে। বিগত সময় পুলিশ মানবপাচারকারীদের আটক করে। বেশ কয়েকমাস ধরে পুলিশী অভিযানে নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে মানবাপাচরকারী র্দুবৃত্তরা বাড়িঘরে ফিরে এসে আরাম আয়েশে দিনযাপন করছে। তারা বীরদর্পে চলাফেরা করার সুযোগে পাওয়ার কারনে ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে ক্ষতিগ্রস্থদের স্বজনহারাদের মাঝে।
জানা গেছে,মালয়েশিয়া মানবপাচারের জন্য সংঘবদ্ধ দালালচক্র চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার সাতটি জেটিঘাটকে নতুনরুট হিসেবে ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আটক মালয়েশিয়াগামী যাত্রী, পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। স্বল্প খরচে স্বপ্নের মালয়েশিয়ায় পাঠানোর নামে এক শ্রেণীর দালালচক্র দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদেশগামীদের জড়ো করে এসব পয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিন চালিত বোটে তুলে দিচ্ছে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে মাঝেমধ্যে ধরা পড়ছে একাধিক প্রতারিত যুবক। তারপরও প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় গমন ঠেকানো যাচ্ছেনা উপজেলার উপকুলীয় অঞ্চলের এসব পয়েন্টে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের মাছঘাট, সাহারবিল ইউনিয়নের চৌয়ারফাঁড়ি ঘাট, বদরখালী ইউনিয়নের বদরখালী ১নং ওযার্ডের ঘাট এলাকা, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট এবং পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের করিমদাঁদ মিয়ার জেটিঘাট, মগনামা ইউনিয়নের মগনামা জেটিঘাট ও রাজাখালী ইউনিয়নের আরবশাহ বাজার ঘাট দিয়ে প্রতিনিয়ত মালয়েশিয়ায় মানবপাচার হয়ে আসছে।
চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকা হয়ে সমুদ্র পথে মানব পাচার এখনও অব্যাহত থাকায় দীর্ঘ একমাস সাগরে ভাসিয়ে রেখে মানব পাচারকারীরা দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৩৫ যুবকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে আবারও দেশের মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে। এ অভিযোগে গত ১৩ আগষ্ট পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের এক ভুক্তভোগী বাদী হয়ে ১০জনের বিরুদ্ধে চকরিয়া থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন।
পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের বদিউদ্দিন পাড়ার মৃত নাগু মিয়ার পুত্র মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ মানব পাচারে জড়িত একটি সিন্ডিকেটের ১০জন সদস্যের বিরুদ্ধে গত ১৩ আগষ্ট চকরিয়া থানায় একটি এজাহার দিয়েছেন। ওই এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে মানব পাচারকারী দলের সদস্যরা তাকে এবং একই এলাকার মৃত ফয়েজ আহমদের পুত্র হুমায়ুন কবিরকে লিবিয়ায় নেয়ার কথা বলে গত ৮ ফেব্রুয়ারী ৮লাখ টাকা নিয়ে একটি চুক্তিপত্র করে। চুক্তিপত্র সম্পাদনের একমাস পর গত ৩মার্চ তাদেরকে লিবিয়া নেয়ার উদ্যেশ্যে পাচারকারীদের নিজস্ব এফ.বি দরবার শরীফ নামের একটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে তুলেন। ওই ট্রলারে দেশের বিভিন্ন এলাকার আরও ৩৫জন লোক ছিল। তাদেরকেও লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রলারে তুলে। লিবিয়ার উদ্দেশ্যে সাগর পথে রওনা দিয়ে প্রায় এক মাস সাগরে ভাসিয়ে রাখে। এক মাস সাগরে ভাসিয়ে রেখে লিবিয়ায় প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে তাই ট্রলার কূলে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না বলে অজুহাত তুলে আরও কয়েকদিন পর ট্রলারটি নিয়ে গিয়ে বরিশালে নামিয়ে দেয়। পরে টাকা ফেরত চাইলে তাদেরকে আবার মালেশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে কালক্ষেপন করতে থাকেন অভিযুক্ত পাচারকারীরা। গত ৬ আগষ্ট অভিযুক্ত মানব পাচারকারী দলের সদস্যদের কাছ থেকে টাকা ফেরত চাইলে তারা টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ভুক্তভোগী মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় মানব পাচারকারী দলের ১০ সদস্যের বিরুদ্ধে একটি এজাহার দায়ের করেছেন। এজাহারে যাদেরকে আসামী করা হয়েছে তারা হচ্ছেন, পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের বদিউদ্দিন পাড়ার মৃত জেবর মুল্লুকের পুত্র আক্তার আহমদ (৬০), আক্তার আহমদের পুত্র কামাল হোসেন(৩৫), আমির হোসেন (৪০), এনামুল হক(৩০), দিদার (২৭), চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের মরং ঘোনার আবদু শুক্কুরের পুত্র মোহাম্মদ শফি (৪৫), নাছির উদ্দিনের পুত্র হেলাল উদ্দিন(২৮), ঢেমুশিয়া জমিদার পাড়ার আক্তারের পুত্র কাইয়ুম (৩৫), কৈয়ারবিলের মোস্তাকের পুত্র কামাল হোসেন(৩৫)। চকরিয়া থানার ওসি প্রভাষ চন্দ্র ধর জানিয়েছেন, এজাহারটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসাবে এস.আই মোজাম্মেলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে তিনি আগের তুলনায় এখন মানবপাচার হচ্ছে না বলে জানান।