কিডনি দিবি, নাকি সারা জীবন জেলে থাকবি। যদি কিডনি দিস তাহলে অনেক টাকা পাবি। ওই টাকা দিয়ে অসুস্থ স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে বাকি জীবন সুখে থাকতে পারবি। কথাটি সরকারের সাবেক এক অতিরিক্ত সচিবের। যিনি মিথ্যা মামলায় জেলের ভয় দেখিয়ে গৃহকর্মীর কাছ থেকে নিজের সন্তানের জন্য এভাবেই জোরপূর্বক কিডনি আদায় করেন। সাবেক এ অতিরিক্ত সচিবের নাম সৈয়দ আমিনুর রহমান। যার এহেন গুরুতর অন্যায় কাজে সহায়তা করেছিলেন গুলশান থানার সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। আর শেষ পর্যন্ত জেল-জলুমের ভয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিডনি দিতে বাধ্য হন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বহুতি গ্রামের আয়রন নেছা। শুধু এখানেই শেষ নয়, কিডনি দেয়ার বিনিময়ে ১০ লাখ টাকা দিতে চাইলেও দেয়া হয় মাত্র আড়াই লাখ টাকা। অতিরিক্ত সচিবের ছেলে সুস্থ জীবনে ফিরে এলেও কিডনি দিয়ে একরকম মৃত্যুশয্যায় দিনাতিপাত করছেন অজ পাড়াগাঁয়ের আয়রন নেছা। তার খবর এখন কেউ রাখে না। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি এক বছরের বেশি সময় ধরে ধামাচাপা থাকলেও যুগান্তরের ১ মাসের অনুসন্ধানে আদ্যপ্রান্ত বেরিয়ে এসেছে।
যেভাবে ঘটনার শুরু : জয়পুরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চল কালাইয়ের মোসলেমগঞ্জ বহুতি গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলামের স্ত্রী আয়রন নেছা। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি এক মেয়ে আর পঙ্গু স্বামীকে নিয়েই তার অভাবের সংসার। আশপাশের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ আর চেয়েচিন্তে কোনোভাবে চলছিল গরিবের সংসার। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। আর ঋণের টাকা পরিশোধ করতে একপর্যায়ে তিনি কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় পার্শ্ববর্র্তী গ্রামের কামাল নামে এক ব্যক্তি তাকে আশার আলো দেখায়। কামাল তাকে জানায়, ঢাকায় গেলে সে গার্মেন্টে ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। সব মিলিয়ে ১০ হাজার টাকা বেতন পাবে। ওই কথা শুনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন চল্লিশোর্ধ্ব আয়রন নেছা।
আঞ্চলিক ভাষায় আয়রন নেছা যুগান্তরকে বলেন, সংসার চলাতে (চালাতে) হামার অনেক দেনা হয়। এজন্য হামি এনজিও আশা থেকে ২০ হাজার, আইআরডিপি থেকে ৪০ হাজার, ব্যুরো বাংলা থেকে ২০ হাজার, ব্র্যাক থেকে ২০ হাজার, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১০ হাজারসহ স্থানীয় একজনের কাছ থেকে ১৫ হাজার টেকা (হফ্কা) ঋণ লিচোনো (নেই)। সে জন্যে ওই লোকক প্রতি ৬ মাসে হাজারপ্রতি দেড় হাজার টেকায় (টাকায়) সুদে দেয়া লাগত। আয়রন নেছার ভাষায়, ঋণের বাজা (বোঝা) ভারি হতে থাকায় পাওনাদারদের কাছ থেকে চাপ বাড়তে থাকে। বাধ্য হয়ে তিনি গত বছর (২০১৪ সালে) ঈদুল ফিতরের পর কামালের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। তিনি জানান, কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর একটি গার্মেন্টে চাকরিও পান। বেতন মাত্র চার হাজার টাকা। আয়রন নেছা বলেন, দেনা শোধ করা তো দূরের কথা, ওই টাকায় তিনি নিজেই চলতে পারতেন না।
আয়রন নেছা বলেন, গার্মেন্টে কাজ করার সময় সেখানে এক লোকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। অভাবের কথা শুনে সেই লোক সচিবালয়ের বড় এক কর্মকর্তার সঙ্গে তাকে পরিচয় করে দেয়। আয়রন নেছার ভাষায়, সবাই তাকে স্যার বলেই ডাকে। তিনি বলেন, পরিচয়ের পর ওই স্যার তাকে বাসায় নিয়ে যায়। ওই বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে তিনি প্রায় ২ মাস কাজ করেন। এর একপর্যায়ে তিনি (সাবেক অতিরিক্ত সচিব) তার ছেলের জন্য একটি কিডনি দিতে বলেন। বিনিময়ে মোটা অংকের টাকার লোভও দেখান। আয়রন নেছা বলেন, প্রথমদিকে রাজি না হলেও একপর্যায়ে তিনি কিডনি দিতে রাজি হন। তবে তার আগে তিনি গ্রামে থাকা স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে চান। কথামতো সাবেক ওই অতিরিক্ত সচিব জয়পুরহাট থেকে আয়রন নেছার স্বামী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।
আয়রন নেছা বলেন, সব পরীক্ষা শেষে ওই সারের ছেলে নাফিজের সঙ্গে হামার কিডনি সেট (ম্যাচিং হওয়ায়) হলে হামার স্বামীক কিডনি বেচার সিদ্ধান্তের কতা (কথা) জানাই। কিন্তু হামার স্বামী তাতে অমত দেয়। স্বামী তাকে বলেন, দরকার হয় না খাইয়া থাকমু। তোক (তোকে) কিডনি বিক্রি করতে দিমোনা (দেব না)। আয়রন নেছা বলেন, ওই রাতে তার স্বামী তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাাকটিও করেন। পরে তিনি ভোরে স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় ওই স্যারের বাসা থেকে পালিয়ে গ্রামে চলে যান।
মিথ্যা মামলার ফাঁদ : স্বামীকে নিয়ে আয়রন নেছা যেদিন ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যান সেদিন ছিল ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর। কিন্তু বিধিবাম। গ্রামে গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারেননি। অতিরিক্ত সচিব তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেন। গুলশান থানায় হাজির হয়ে আয়রন নেছা ও স্বামীর বিরুদ্ধে চুরির মিথ্যা মামলা ঠুকে দেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ আমিনুর রহমান। তার বাসা গুলশান ১ নম্বর সার্কেলের ১০ নম্বর রোডের ২১/এ। প্রধান অভিযোগ, বাসার গৃহকর্মী আয়রন নেছা ও তার স্বামী নজরুল ইসলাম তার বাসা থেকে নগদ দুই লাখ টাকা ও ১২ ভরি সোনার গহনা নিয়ে পালিয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই সময় থানায় ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন এসআই মো. সাব্বির রহমান। সরকারের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি সৈয়দ আমিনুর রহমানকে বেশ খাতির-যত্ন করেন। পরে তিনি বিষয়টি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বর্তমানে গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রফিকুল ইসলামকে জানান। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা শেষে ডিউটি অফিসার এসআই মো. সাব্বির রহমান অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করেন। মামলা নম্বর-১০। তারিখ ৭/১১/২০১৪। ধারা ৩৮১ (গৃহকর্মী কর্তৃক চুরি করার অপরাধ)। মামলায় চোরইকৃত মালামালের মূল্য দেখানো হয় ৮ লাখ টাকা।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ আমিনুর রহমান এজাহারে বলেন, তার দুটি সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে পেশায় একজন ডাক্তার। তিনি বর্তমানে এ্যাপোলো হাসপাতালে কর্মরত। কিছুদিন পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত সচিব নূরুজ্জামান ভূঁইয়ার ছোট ছেলে পারভেজ ইমতিয়াজের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হয়। ঘটনাচক্রে জয়পুরহাটের পুনট পাঁচ লাইশ গ্রামের ব্যবসায়ী জহুরুলের সঙ্গে তার মেয়ে জামাইয়ের পরিচয় হয়। সে (জহুরুল) তার শাশুড়ি আয়রন নেছাকে আমার বাসার গৃহকর্মী হিসেবে কাজে দেয়। আরও বলা হয়, কয়েকদিন আগে তার (আয়রন নেছা) স্বামী নজরুল ইসলাম বিভিন্ন কাজের উসিলায় আমার বাসায় এসে থাকে। ৪ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের পর থেকে আয়রন নেছা ও তার স্বামী নজরুল ইসলামকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাসায় জিনিসপত্র তল্লাশি করে দেখা যায়, আমার সদ্য বিবাহিতা মেয়ের ১২ ভরি সোনার গহনা ও নগদ ২ লাখ টাকা নেই। গত ২ দিন বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে তারা মালামাল চুরি করে গ্রামের বাড়িতে লুকিয়ে আছে বলে জানতে পেরেছি। এ অভিযোগে মামলা দায়েরের দুদিনের মাথায় গুলশান থানা পুলিশের সহায়তায় জয়পুরহাটের কালাই থেকে গ্রেফতার করে আনা হয় আয়রন নেছা ও তার পঙ্গু স্বামী নজরুল ইসলামকে।
থানায় দরকষাকষি : তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এখান থেকেই শুরু হয় কিডনি সংগ্রহের কূটকৌশল। থানা-হাজতে রেখে পুলিশের সহায়তায় চলে দরকষাকষি। এ সময় ওই অতিরিক্ত সচিব পুলিশের সামনে আয়রন নেছাকে বলেন, কিডনি দিবি, নাকি সারা জীবন জেলে থাকবি। যদি কিডনি দিস তাহলে অনেক টাকা পাবি। ওই টাকা দিয়ে অসুস্থ স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে বাকি জীবন সুখে থাকতে পারবি।
এ প্রসঙ্গে আয়রন নেছা শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, থানায় আটকে রেখে পুলিশের সামনে তাকে বলা হয়, কিডনি দিতে রাজি হলে তাকে (আয়রন) ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আর রাজি না হলে সারা জীবন জেলের ঘানি টানতে হবে। আয়রন নেছা বলেন, একথা শুনে তার স্বামী কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক রাত থানায় থাকার পর তিনি স্বামীকে রাজি করান। পরের দিন দুপুরে স্যার (সাবেক অতিরিক্ত সচিব) তাদের দুজনকে থানা থেকে ছাড়িয়ে বাসায় নিয়ে যান। আয়রন নেছার ভাষায়, বাসায় নেয়ার পর তাকে ও তার স্বামীকে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়।
কিডনি নিয়েও প্রতারণা : আয়রন নেছা জানান, থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ২০ থেকে ২৫ দিন পর তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি হাসপাতালে অপারেশনের পর তার একটি কিডনি স্যারের (সাবেক অতিরিক্ত সচিব) ছেলে নাফিজকে দিয়ে দেয়া হয়। ১৫ দিন ভারতের হাসপাতালে থাকার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ঢাকায় ওই বাসায় এসে তিনি তার স্বামীকে দেখতে পান। পরে তাদের হাতে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে এ কথা কাউকে না জানানোর জন্য বলা হয়। এরপর তারা স্বামী-স্ত্রী জয়পুরহাটে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। আয়রন নেছা বলেন, ওই টাকা দিয়ে তিনি ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কিছু দেনা পরিশোধ ছাড়াও ঘরের কিছু কাজ করিয়েছেন। কিন্তু এখন তারা নিঃস্ব। বাকি টাকা চাইলেও আর দেয়া হয়নি। উল্টো ধমক দিয়ে বলেন, তোদের থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে পুলিশকে দিতে হয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আয়রন নেছা বলেন, কিডনি দেয়ার পর থেকেই তার শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। মাঝে-মধ্যেই শরীর ফুলে যায়। তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না।
সাজানো মামলার ফাইনাল রিপোর্ট : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গুলশান থানা পুলিশ ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট (রিপোর্ট নং ৬৭, তাং ৩০.০৬.১৫) দিয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার এসআই আবদুল্লাহ আল মামুন ফাইনাল রিপোর্টে উল্লেখ করেন, বাদী মামলা পরিচালনা করতে না চাওয়ায় এবং প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হওয়ায় প্রত্যাহারের আবেদন করছি।
এ প্রসঙ্গে এসআই আবদুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, মামলা দায়েরের কয়েকদিন পর বাদী সাবেক অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ আমিনুর রহমান মামলাটি পরিচালনা না করার কথা জানান। এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর লিখিত আবেদনও করেন। তিনি বলেন, বাদী যদি মামলা পরিচালনা করতে না চান সেক্ষেত্রে তাদের কিছু করার থাকে না। এ মামলা প্রত্যাহারের পেছনে কিডনি বিক্রি সংক্রান্ত কোনো কিছু শুনেছেন কিনা প্রথমে এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলেও একপর্যায়ে তিনি বলেন, কিছু গুঞ্জন তিনি শুনেছিলেন। তবে মামলা সংক্রান্ত বিষয় না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেননি। গুলশান থানার তৎকালীন ওসি বর্তমানে একই জোনের সহকারী কমিশনার রফিকুল ইসলামও বিষয়টি পরে শুনেছেন বলে যুগান্তরকে জানান।
এদিকে গুরুতর এ অভিযোগ প্রসঙ্গে সাবেক অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ আমিনুর রহমানের সঙ্গে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর শুক্রবার সন্ধ্যায় তার গুলশানের বাসায় গেলে তিনি বাসার কেয়ারটেকার বাদশার মাধ্যমে জানিয়ে দেন এখন তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না। পরে কথা বলবেন বলে প্রতিবেদকের মোবাইল নম্বর রেখে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি পরে আর যোগাযোগ করেননি।
সূত্র জানায়, এ অতিরিক্ত সচিব যে মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করে আসছেন তা জান্নাতুল নাইম নামে এক ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রেশন করা। ঠিকানা-ক, ১১ দক্ষিণ বাড্ডা। কিন্তু এ ঠিকানায় গিয়েও এ নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি নিজেই ভুয়া সিম ব্যবহার করছেন।