কক্সবাজার আলো ডেস্ক :
কোনো নিয়ম মানছেন না ওষুধ কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধিরা (মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ)। যখন-তখন ঢুকে পড়ছেন চিকিৎসকের কক্ষে। কখনও রোগীরা চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসক্রিপশন নিয়ে শুরু করেন টানাহেঁচড়া।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, নিজেদের কোম্পানীর ওষুধ না লিখলে চিকিৎসকের কাছে কৈফিয়ত চাইতেও অনেকে দ্বিধা করেন না। এতে হাসপাতালে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত কয়েকদিনে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা কোনো আদেশ মানছেন না। কিন্তু তারা হাসপাতালের বাইরে কখনো চিকিৎসকের কক্ষের বাইরে ব্যাগ রেখে অনায়াসে রোগীর দর্শনার্থী সেজে ভেতরে ঢুকে পড়ছেন। আর এরই মাঝে কাজ সেরে নিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত, বহিঃ বিভাগে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার পর এবং রোববার দুপুর ২টার পর মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। অন্তঃ বিভাগে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভদের প্রবেশ না করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে শীর্ষস্থানীয় দুই-একটি ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভ ছাড়া এ নিয়মনীতি কেউ মানছেন না। নানা কৌশলে সকাল ১০টা থেকেই তারা ভেতরে ঢুকে পড়েন। হাসপাতালের বহির্বিভাগে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের থাকে জটলা। চিকিৎসকদের কক্ষ থেকে রোগীরা বেরিয়ে এলেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করেন বিভিন্ন কো¤পানির প্রতিনিধি। এতে অনেক রোগী ভয়ে আঁতকে ওঠেন। চিকিৎসকের কক্ষের সামনে দায়িত্বরত কর্মচারীরা জানান, নির্ধারিত সময়ের বাইরে চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে তারা কখনও সাদামাটা পোশাকে আবার কখনও রোগী সেজে চেম্বারে ঢুকে পড়েন।
কক্সবাজার সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ের বাইরে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সময় না দেয়ার জন্য প্রত্যেক চিকিৎসককে চিঠি দিয়েছেন। হাসপাতালের দেয়ালে দেয়ালে ওই নির্দেশনার কপিও সেঁটে দেয়া হয়েছে। তবে নির্দেশনা মেনে চলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা চরমভাবে উদাসীন।
জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ২০০ মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ বিভিন্ন ওষুধ কো¤পানির হয়ে কক্সবাজারে কাজ করছেন। প্রতিটি কোম্পানী থেকে বিক্রয় প্রতিনিধিদের ওপর একটি চাপ থাকে নির্দিষ্ট ওষুধের বিক্রি বাড়ানোর। আর ওষুধের বিক্রি বাড়ানো ও লক্ষ্য মাত্রা পূরণের ওপর নির্ভর করে তাদের চাকরি। এ কারণে প্রেসক্রিপশনে বেশি ও প্রতিটি কোম্পানীর প্রতিনিধিরা ওষুধ লেখাতে অনেক সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। চিকিৎসকদের ‘ম্যানেজ’ করতে প্রয়োজনীয় উপহার কোম্পানীর পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হয়। আর এ কারণে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা তাদের পছন্দের কোম্পানীর ওষুধ লিখতে কনিষ্ঠদের প্রভাবিত করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, প্রতি সপ্তাহে তাদের একটা টার্গেট দেয়া হয়। ওই টার্গেট অনুপাতে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন কিনা, তা-ও মনিটর করতে হয়। প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করানোর জন্য মোবাইলে প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে রাখতে রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখতে হয়। আর তার জন্য সকাল থেকে হাসপাতালে থাকতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চিকিৎসকরা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন। এর প্রধান কারণ বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর কাছ থেকে বিভিন্ন উপহার নেয়া। এসব উপহারের মধ্যে রয়েছে বিদেশে যাওয়ার যাবতীয় খরচ, ঘরে ফার্নিচার, এসি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, ল্যাপটপসহ নানা জিনিস। এর ফলে চাপে পড়ে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধসহ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ লিখছেন। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া আইন করেছে ওষুধ কো¤পানির কাছ থেকে ‘উপহার’ নিলে বিভিন্ন মেয়াদে চিকিৎসা সনদ বাতিলের। তবে বাংলাদেশে অদ্যাবধি এ সংক্রান্ত কোনো নিয়ম তৈরি হয়নি। তবে চিকিৎসকরা বলেছেন, বাজারে নতুন ওষুধ এলে ওষুধের জেনেটিক নাম এবং ব্রান্ডের নাম জানতে চিকিৎসকরা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ওপর নির্ভর করেন।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রতন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের জন্য নির্ধারিত সময় দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। কিন্তু অনেকেই সেই নির্দেশনা মানছেন না। কেউ অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করে হাসপাতালে এসব বিক্রয় প্রতিনিধিদের ভীড়ের বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরদারী না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার সুযোগে তারা ঢুকে পড়েন। যার কারণে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’