দুইদিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে কক্সবাজারে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পাহাড় ধসে চকরিয়ায় দুই শিশু নিহত হয়েছে। ব্রীজের নিচে লাকড়ী কুড়াতে গিয়ে এক ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছে। নিহত দুই শিশু চকরিয়ার বরইতলী ইউনিয়নের বলে জানা গেছে।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছালেকুজ্জামান জানান, এক সপ্তাহ ধরে থেমে থেমে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। সোমবার বিকালে বরইতলী ইউনিয়নে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় আনোয়ার হোসেনের ঘরের দেয়ালে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে তার ৫ বছর বয়সী ছেলে সাবির ও ১ বছর বয়সী মেয়ে তাবাবসুম চাপা পড়ে।
এদিকে পাহাড় ধসে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মা-মেয়ে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো ৪ জন।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টার উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প-৯ এই ঘটনা ঘটে। নিহত মা- মেয়ে ক্যাম্প ৯ এর এ/৬ ব্লকের আনোয়ার ইসলাম (৩২) এর স্ত্রী জান্নাত আরা (২৮) ও তার মেয়ে মাহিম আক্তার (২) বলে জানান ৮-এপিবিএন এর কমান্ডিং অফিসার মো: আমির জাফর।
গত ২৪ ঘন্টায় অনবরত বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় ধসের শঙ্কাও। এদিকে বাঁকখালী নদীসহ বঙ্গোপসাগরে জোয়ারের পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করছে। বৃষ্টির এ তীব্রতা ১০ আগস্ট পর্যন্ত থাকলে ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। গত রবিবার বেলা ১২ থেকে থেকে সোমবার (৭ আগষ্ট) বেলা ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ফলে কক্সবাজারে ফের দেখা দিয়েছে পাহাড় ধসের শঙ্কাও। এতে জেলার প্রায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
টানা বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলার ১০ গ্রাম, মহেশখালী উপজেলার ১৫ গ্রাম, কুতুবদিয়া উপজেলার ১৫ গ্রাম, চকরিয়ার ২০ গ্রাম, উখিয়ার উপজেলার ১০ গ্রাম, রামু উপজেলা ২০ গ্রাম, টেকনাফে ১০ গ্রাম ও প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রায় ১৪টি গ্রাম। এতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন।
এছাড়াও ঢল ও বৃষ্টির পানিতে নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। রাস্তাঘাট ভেঙ্গে ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফলে জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। তলিয়ে গেছে কৃষি ফসল ও বিভিন্ন মাছের প্রজেক্ট।
তবে যেকোনো দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসন প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার স্টেশনের সিনিয়র সহকারি আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান পাহাড় ধ্বসের শঙ্কা রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, শনিবার রাত থেকেই অতি ভারি বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। শনিবার রাত ১২ থেকে রবিবার রাত ১২ টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে ৯৮ মিলিমিটার। বৃষ্টির তীব্রতা থাকতে পারে ১০ আগস্ট পর্যন্ত।
তিনি আরো বলেন, টানা বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়গুলো কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন ধরে যে ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাতে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা আছে।
সূত্র জানায়, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে সারা বছর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না প্রশাসন। অথচ প্রতিবছর বর্ষা শুরু হলেই তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং চলে জোরেশোরে। এ ঘোষণাও মাইকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় পাহাড় ধসে ঘটে মৃত্যুর ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসন দায় এড়ানোর জন্য কোনোরকম মাইকিং কিংবা জরুরি মিটিং করে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে।
এদিকে গত কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ ও ঝড়ো বাতাসে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যে কোনো মুহুর্তে ঘটতে পারে প্রাণহানির ঘটনা। এ আশঙ্কায় এ বছরও লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং করছে প্রশাসন। স্বেচ্ছায় না সরলে অভিযানের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার শহরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে পাহাড় বেষ্টিত পাহাড়তলী, লাইটহাউজ, ফাতেরঘোনা, কলাতলী, আদর্শগ্রাম, পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, খাজামঞ্জিল, ঘোনারপাড়া, মোহাজের পাড়া, কবরস্থান পাড়া, গরুর হালদা সড়ক, সিটি কলেজ এলাকা, সাহিত্যিকা পল্লী, বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকাসহ ৬টি ওয়ার্ডে পাহাড়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করে। ভারি বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধসে এসব এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। অতীতেও এসব পাহাড় ধস হয়েছে।
এছাড়া মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজার সদরের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় সেখানেও মাইকিং করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, অতি বর্ষণে জেলার মিঠাপানির তিন নদী চকরিয়ার মাতামুহুরি, ঈদগাঁওর ফুলেশ্বরী ও কক্সবাজারের বাঁকখালীতে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পাহাড়ি ঢলের পানি। ঢলের তীব্রতায় ভেঙ্গে যাওয়া ঈদগাঁওর রাবার ড্যাম এলাকা দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ, ঈদগাঁও, চৌফলদন্ডী, পোকখালী ও ইসলামাবাদ এলাকার অর্ধশত গ্রামের রাস্তা-ঘাট, বাসা-বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ফসলের মাঠ। ভেঙ্গে গেছে আঞ্চলিক সড়কগুলো।
এছাড়া কক্সবাজার শহরসহ টেকনাফ, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, রামুসহ বেশ কয়েক উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঢলের পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানিতে ওইসব এলাকাগুলোতে কোমর সমান পানি জমে গেছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, অতি বর্ষণে পাহাড় ধসের যেকোনো দুর্ঘটনা এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরাতে কাজ চলছে। পাহাড়ে অবস্থানকারীদের সরিয়ে এনে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রবল বর্ষণের মাতামুহুরীর নদীর পানি বেড়ে চকরিয়া উপজেলার পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড এবং সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, কোনখালী, ঢেমুশিয়া, খুটাখালী, ডুলাহাজারা, সাহারবিল পুরোসহ ১৭ ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে চকরিয়া উপজেলায় মাঝারি বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা ও নদী ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভূমি ধসের আশঙ্কাও রয়েছে। ইতোমধ্যে উপকূলের মৎস্য ঘেরের স্লুইচ গেটগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। জেলার মধ্যে সবচেয়ে চকরিয়া উপজেলাতে সর্বোচ্চ পানি বৃদ্ধি ও ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করছেন তিনি।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া শাখার কর্মকর্তা জামাল মোর্শেদ বলেন, টানা ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদীতে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়ন, রাজাখালী, মগনামাসহ সবকটি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। এসব স্থানের অনেক লোকজন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আশ্রয়কেন্দ্র ও ইউপি ভবনসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।
বাঁকখালী নদীর পানি উপচে পড়ে রামু উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, রাজারকুল ও ফতেখাঁরকুলে ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রামু দক্ষিণ মিঠাছড়ি কাটির মাথা এলাকায় অতিরিক্ত পানি বেড়ে যাওয়ায় টেকনাফ কক্সবাজার সড়কের যোগাযোগও ব্যাহত হয়।
কক্সবাজার পৌরসভার সমিতিপাড়া, টেকপাড়া, গোলদীঘিরপাড়, বাজারঘাটা, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, বাহারছড়া, আলীরজাহালসহ আরও বিভিন্ন ওয়ার্ড কোমর সমান পানিতে ডুবে গেছে। এতে প্রায় লক্ষাধিক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সড়কে কোমর সমান পানির কারণে যান চলাচল অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানান, প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে হ্নীলা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের সড়কের ওপরে পানি। যার কারনে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ধানের বীজতলা, পানের বরজের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইতিমধ্যে পরিষদের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হচ্ছে। সবচেয়ে প্লাবিত হয়েছে ৭নং ওয়ার্ডের রংগীখালী লামারপাড়া এলাকা। এতে প্রায় ৩০০ পরিবার পানিবন্দি হয়।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে সেখানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত খাদ্য দ্রব্য সরবরাহ করা হবে। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশাসন পক্ষ থেকে সবরকম প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করা হচ্ছে। সবশেষ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসার জন্য জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।