বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৫৬ সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের অস্ত্র ও গুলি বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) কাছে জমা রাখা আছে। রোববার বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিতও করেছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ভেতরে গতকাল শনিবার রাতে শুরু হওয়া গোলাগুলি গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলছিল। বিরামহীন গোলাগুলির ঘটনায় ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু, কোণারপাড়া, ভাজাবনিয়া, বাইশফাঁড়ি এলাকার শত শত পরিবার যে যেদিকে পারছেন, নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৫ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট হলেও যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে তথা কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তে!
মিয়ানমার সীমান্তকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ চরম জায়গায় পৌঁছে গেছে। ২০১৭ সালের সেই নির্মম স্মৃতির পর, মিয়ানমারের দিক থেকে আবার এই আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি খুব জটিল।
এর কারণ শুধু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের সীমান্তে আবার ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে তা নয়, গোলাগুলিও শুরু হয়েছে। এর ফলে অশান্ত হয়ে উঠছে সীমান্ত। আবার এর মধ্যে মিয়ানমারেরই সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটা ‘যুদ্ধংদেহী’ পরিস্থিতি।
রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে বড় দেশগুলোর অবস্থান মিয়ানমারের পক্ষে। এর কারণ অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এই দুই বিবেচনায় তাদের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্ব বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়ে বেশি। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের সীমাবদ্ধতার প্রধান সমস্যাগুলো বাংলাদেশ মিটিয়েছে। চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহুদিনের। বর্তমান সরকার রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে বড় পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে ১০০ কোটি ডলারের সামরিক অস্ত্র ক্রয় ও পারমাণবিক শক্তিতে সহায়তার মতো বড় চুক্তি রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ও রাশিয়ার পূর্ণ সমর্থন ছিল। তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনের মতো নৃশংস আচরণের বিষয়ে তাদের অবস্থান এমন কেন, তা বুঝতে হলে মিয়ানমারকে ঘিরে এই তিন দেশের ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অবস্থানের বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
আর এভাবে যদি চলতে থাকে এটা তো বাংলাদেশের জন্য একটা মস্ত বড় বোঝা হয়ে উঠবে। এখনই সমাধান-সূত্র না দিলে আগামী দিনে বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে।
মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলো এই সংকট সমাধানে যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে না। (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ আগস্ট ২০২০)। রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের দাবিও জানিয়েছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। তিনি আসিয়ান রিজিওনাল ফোরামের ২৭তম বৈঠকে বলেছেন, এই সমস্যা দ্রুত সমাধান না করলে এখানে চরমপন্থীদের উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে। (দ্য ইনডিপেনডেন্ট, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০)।
রোহিঙ্গা সমস্যা যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য কতটা ঝুঁকি বাড়িয়েছে, তার প্রমাণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা, অহরহ গোলাগুলি এবং অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে ভূকৌশলগত, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনীতির বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ক্রমে বৃহত্তর অস্থিরতার মধ্যে পড়তে পারে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের, বিশেষ করে আঞ্চলিক ও ইন্দো-প্যাসিফিক ভূরাজনৈতিক ঘূর্ণির মধ্যে বাংলাদেশ পড়তে পারে, যা বাংলাদেশের অগ্রগতি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য সহায়ক হবে না।
দিন দিন যেভাবে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা কট্টরপন্থী মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। আর এসব কট্টরপন্থী যুবকদের কাছে টানার চেষ্টা করছে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন। জঙ্গি সংগঠনগুলো এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে বাংলাদেশে।
নিরাপত্তা বিশেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ১৯/১২/২০১৭ সালে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক মন্তব্যে বলেন,আরসার ২০০ সদস্য দা-কুড়াল এবং কিছু ছোট অস্ত্র নিয়ে একই সময়ে সেনা ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারসহ ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়েছে৷ আমার যতটুকু সামরিক জ্ঞান আছে, তাতে মনে হচ্ছে, অত অল্পসংখ্যক মানুষের, এত কম সময়ে একটা নিয়মিত বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের হামলা চালানো কিছুতেই সম্ভব নয়৷ বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিতে তারা (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) তাদের লোক দিয়ে এ হামলা করিয়েছে কিনা, সেটা চিন্তা করতে হবে৷'' তিনি বলেন, প্রচুরসংখ্যক ৯-১০ বছরের শিশু কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে৷ যাদের সামনে বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে এবং বোনকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ তারা এক সময়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে৷ তেমনটা হলে এটা শুধু মিয়ানমারের জন্যই নয়, আশ্রয়দাতা বাংলাদেশের জন্যও নেতিবাচক হতে পারে৷ তাই ওইসব শিশুর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে৷
রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে নয়টি তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ক্যাম্পগুলোর অবস্থান পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় কোনওভাবেই রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে সীমানা প্রাচীর বা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হলেও তা কোন কাজে আসছে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করা না হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অপপ্রচার বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের সাথে আন্তর্জাতিক যে কোন সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করা জরুরি।
সমুদ্রসীমা নিয়ে দ্বন্দ্ব এখনো জিয়ে রয়েছে
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ১৭০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ইতোপূর্বে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশে জল ও স্থলসীমান্তে অস্থিরতা ও সংঘাতপূর্ণ পরিবেশের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০০৮ সালে দুই দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। সে সময়ে মিয়ানমার নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করেছিল। অন্যদিকে কথায় কথায় মিয়ানমারের উড়োজাহাজ কর্তৃক বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বহুবার।
তথ্য সূত্রে -বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতা ভূমি ও জনগোষ্ঠীর অধিকার