সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনি জটিলতার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দিতে পারছে না প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতারা প্রধান শিক্ষক পদে নিজেদের পদোন্নতি চেয়ে আদালতে মামলা করে রেখেছেন। এছাড়া সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দিলেও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন হয়েছে-এমন অভিযোগে অনেক শিক্ষক আদালতে মামলা করে রেখেছেন। ফলে উদ্যোগ নিয়েও সারা দেশে প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণ করতে পারছে না মন্ত্রণালয়।
কক্সবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ৬৫৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৪৯টিতে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৯০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকরা পালন করছেন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। অথচ পদোন্নতিযোগ্য শূন্য পদ রয়েছে ৩৪০টি। এছাড়া শূন্য রয়েছে ৩৫২টি সহকারী শিক্ষকের পদ। এর মধ্যে সদর উপজেলায় প্রধান শিক্ষক নেই ৫৩টি বিদ্যালয়ে। এছাড়া রামুতে ৪৮টি, চকরিয়ায় ৭৪টি, পেকুয়ায় ৩২টি, কুতুবদিয়ায় ৩৫টি, মহেশখালীতে ৩৩টি, উখিয়ায় ৩৭টি ও টেকনাফে ৩৭টি বিদ্যালয়ে শূন্য রয়েছে প্রধান শিক্ষকের পদ।
শিক্ষকদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক সংকট থাকায় সহকারী শিক্ষককে ওই পদের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে পাঠদানে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রধান শিক্ষক ছাড়া পরিচালিত বিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কাজ সাধারণত সহকারী শিক্ষক চালিয়ে নেন। সহকারী শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিলে কর্মঘণ্টার বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয় প্রশাসনিক কাজে। ফলে পাঠদান ব্যাহত হয়। যার মাশুল দিতে হচ্ছে শিশুদের।
এছাড়া অভিজ্ঞতা না থাকায় দাপ্তরিক কাজে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সহকারী শিক্ষকরা। তাদের অভিযোগ, প্রায় প্রতি সপ্তাহে দাপ্তরিক প্রয়োজনে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে সভায় যোগ দিতে ছোটাছুটি করতে হয়। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারিভাবে কোনো পারিশ্রমিকও দেয়া হয় না। এ অবস্থায় অতিরিক্ত দায়িত্বকে বোঝা হিসেবে দেখছেন অনেকে। দায়িত্ব পালনে অনেকে অনীহাও প্রকাশ করছেন। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয় থেকে সহকারী শিক্ষক কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাহত হচ্ছে পড়ালেখা।
প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগের বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহিদুল আজম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৩ সালের পর থেকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ আর হয়নি। তবে নন-ক্যাডার থেকে কিছু কিছু নিয়োগ হলেও কক্সবাজারে আমরা তা পাইনি। শিক্ষক সংকট শুধু কক্সবাজারের নয়, এটি জাতীয়ভাবে হচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকার ২০২৩ সাল থেকে নিয়োগবিধি প্রস্তুত করে প্রক্রিয়া চালু করেছে। আশা করি, শিগগিরই আমরা এ প্রক্রিয়ায় প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণ করতে পারব। শূন্য পদের বিপরীতে তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আগের নিয়ম অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া হলো ৩৫ শতাংশ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে এবং ৬৫ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে নন-ক্যাডার থেকে সারা দেশে ৮৮১ জনের তালিকা প্রস্তুত করে সরকার। সেখান থেকে বিধি অনুযায়ী ৩৫ শতাংশ প্রধান শিক্ষকের পদ পূরণ করা হয়।’
এদিকে প্রধান শিক্ষক না থাকায় জেলার ৩৪৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। যোগ্যতাসম্পন্ন ও প্রশাসনিকভাবে দক্ষ প্রধান শিক্ষক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হলেও প্রধান শিক্ষক না থাকায় মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। পাঠদান, দাপ্তরিক কার্যক্রম, শ্রেণী ব্যবস্থাপনা, নতুন নতুন কারিকুলাম, সরকারের গৃহীত সৃজনশীল পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগ এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন শিক্ষকরা।
অন্যদিকে প্রতি বছর সহকারী শিক্ষকের পদ পূরণে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালিয়ে এলেও জেলায় এখনো শূন্য রয়েছে ২৫৬টি পদ। গত বছর প্রাক-প্রাথমিকের শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ করা হলেও অনেক শিক্ষক মফস্বল থেকে শহরের প্রতিষ্ঠানে বদলি হয়ে এসেছেন। এজন্য গ্রামের বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে টেকনাফের মতো উপজেলায় সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে পাঠদান। শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় প্রতি বছর ফলাফলে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।
সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোখতার আহমদ বলেন, ‘আমি একা কীভাবে একটা প্রতিষ্ঠান চালাব। গত বছর একজন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দিলেও তিনি নিয়মিত আসেন না। প্রত্যন্ত এলাকায় একটা বড় ভবন ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে। তবুও কোনো শিক্ষক এসে স্থায়ীভাবে থাকতে চান না। এটা নিরসন হওয়া জরুরি। এভাবে চললে শিক্ষার মান কমে যাবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না।’